বসন্তের জাদু

আলী প্রয়াস »

এক ছিল ছোট্ট গ্রাম, নাম তার ফুলনগর। এই গ্রামে ছিল অনেক গাছ, ফুল এবং প্রাণী। শীতের শেষে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, তখন পুরো গ্রামটি যেন নতুন সাজে সেজে ওঠে। চারপাশের প্রকৃতি রঙিন হয়ে যায়। গাছের ডালে ডালে ফুটতে থাকে বিভিন্ন রঙের ফুল, আর সবুজ পাতাগুলো যেন নতুন প্রাণ পায়।
বাংলাদেশের ঋতুচক্রে ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। এটি বছরের শেষ ঋতু। দখিনা ঝির ঝিরে বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে আসে বসন্ত। শীতের নির্জীব প্রকৃতি যেন সহসা জেগে ওঠে। শীতের পরে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ আর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। দখিনা মলয়ে বসন্ত ঋতুর আগমনী বার্তা শোনা যায়। কবির কাছে বসন্ত ঋতুরাজ। গ্রামে ও শহরে বসন্তের আমেজ একেক ধরনের।
ফুলনগর গ্রামের ছোট্ট একটি মেয়ে ছিল, নাম তার পল্লবী। পল্লবী খুব দুষ্টু ও চঞ্চল ছিল। সে সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকতো। বসন্ত আসছে শুনে পল্লবী ও তার বন্ধুরা খুব খুশি হয়ে উঠল। একদিন, তারা ঠিক করলো, তারা বসন্ত উৎসব পালন করবে। কিন্তু কীভাবে?
ভাবতে না ভাবতে ছোট্ট বন্ধু রিয়া হঠাৎ পল্লবীকে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা আপু বসন্ত কি তোমার প্রিয় ঋতু?
হ্যাঁ রিয়া, কেননা বসন্তের আগমনে প্রকৃতি তার জীর্ণতা মুছতে শুরু করে। শীতের পাতা ঝরা বৃক্ষগুলো এত দিন যেন শুকনো দাঁড়িয়ে ছিল রিক্ত বেশে। বসন্ত এসে তাকে দান করে নতুন সজীবতা। মৃতপ্রায় নগ্ন ডালগুলোতে আসে নতুন পাতার আশীর্বাদ। শুকনো মাটির বুক ফেটে গজিয়ে ওঠে মসৃণ সুন্দর ঘাস। বসন্ত আসে পাখির কলকাকলী আর অপার সবুজের সমাহার নিয়ে। গ্রামবাংলার প্রকৃতি এ সময় নবরূপে সজ্জিত হয়। গাছে গাছে নতুন কচি পাতা আর পুষ্প মঞ্জরির সমারোহ। চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেতে সবুজের ঢেউ খেলে। পাতায় পাতায় আলোর নাচন। প্রকৃতি ভরে উঠে এক অনুপম সৌন্দর্যে। রং-বেরঙের ফুলে ফলে ভরে যায় গাছগাছালি। এজন্য বসন্ত আমার এত প্রিয়।
রিয়া বলল, সত্যিই আপু এ ঋতু অনেক সুন্দর!
পল্লবী ভাবতে লাগলো এ সুন্দর ঋতু নিয়ে সবাই মিলে কি করা যায়। ‘আমরা আমাদের পুকুরপাড়ে বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারি!’ বলল সে। বন্ধুরা সবাই তার সঙ্গে একমত হলো। সবাই মিলে পুকুরপাড় পরিষ্কার করে, সেখানে পাতা, ফুল এবং রঙিন কাপড় দিয়ে সাজাতে লাগল।
বসন্তের সকালেই অনুষ্ঠান শুরু হলো। পল্লবী এবং তার বন্ধুরা সুন্দর পোশাক পরে, ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে এসে উপস্থিত হলো। পুকুরপাড়ে এসে তারা গান গাইতে শুরু করলো। পল্লবীর গলা ছিল খুব মিষ্টি। সে গান গাইতে গাইতে বলে উঠল, ‘বসন্ত এসেছে, আনন্দের মেলা, প্রকৃতি আজ সেজেছে নতুন রূপে!’
এদিকে, ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুতানে আর পাপিয়ার পিউ পিউ ডাকে চারদিক মুখরিত হয়। তারাও বসন্তের আনন্দে গান গাইছিল।
পল্লবী বলল—রাতুল জানো, গায়কপাখি কোকিলকে বলা হয় বসন্তদূত। নবপল্লবিত কচি অশ্বত্থ শাখায় বসে ডেকে ওঠে কুহু কুহু। বসন্ত বাউরি ‘বউ কথা কও’ সুরে আমাদের বাড়ির কাঁঠাল পাতার আড়ালে বসে ডাক দিত।
রিয়া ওই দেখ দেখ, ফুলগুলো তাদের গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ সময় পল্লবী দেখলো, তাদের পাশে একটা ছোট্ট ঘুঘু উড়ে এসে বসলো। ঘুঘুটি বলল, ‘বসন্তের আনন্দে তোমরা মেতে উঠেছ! আমি তোমাদের সঙ্গে নাচবো।’
সবাই মিলে ঘুঘুর গান শুনে নাচতে লাগল।
আনন্দ করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেল। শেষ বিকালের গোলাপি আলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই দূর আকাশে চোখ মেলে সন্ধ্যাতারা। রাত নামল। আকাশে তখন লক্ষ তারার মেলা। তাই দেখে জোনাকিরাও বুঝি তারা হতে চাইল। আশ্চর্য সুন্দর বসন্ত রাতের দৃশ্য দেখে সবার শুধু চোখই জুড়াল না, মনও কাড়ল। প্রকৃতির এরূপ লাবণ্য তাদের কিশোর মনকে দোলা দেয়। রাতের এমন রূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে রাতুল গেয়ে উঠলÑ ‘মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে/নয়ন ভোলানো রূপে কে তুমি এলে।’
হঠাৎ করে পল্লবীর মনে হলো, ‘আমাদের এই আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে।’
পল্লবী সিদ্ধান্ত নিল, তারা একটা বসন্তের প্যারেড করবে।
‘হ্যাঁ! আমরা প্রতিটি ফুলের নাম লিখবো, আর তাদের নিয়ে একটি খেলা খেলবো!’ পল্লবী ঘোষণা করল। বন্ধুরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। তারা একত্রে ফুলের ছবি এঁকেও নেবে এবং সেগুলো নিয়ে ছোট ছোট প্লেকার্ড বানাবে।
পল্লবী ও তার বন্ধুরা দলে দলে চলে গেল ফুলের বাগানে। তারা সব ধরনের ফুলের ছবি এঁকে প্লেকার্ড বানাতে শুরু করলো। গোলাপ, শিমুল, অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া জুঁইÑসব ফুলের ছবি তারা এঁকে ফেললো। দৃষ্টিনন্দন রক্তিম ফুলগুলো প্রাণে আনন্দের রং ছড়াল। ওদিক গ্রামে সব বয়সী মানুষ পুকুরপাড়ে জড়ো হতে লাগল।
পল্লবী ও তার বন্ধুরা ফুলবাগান থেকে উৎসবের দিকে যেতে যেতে তারা দেখল, ক্ষেতে ক্ষেতে ছড়িয়ে আছে তরমুজ, খরমুজ, ডাব, বাঙ্গি। আর দেখল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি গাছ মুকুলিত হয়েছে, আমের মুকুলের ম ম গন্ধে হৃদয় ভরে যাচ্ছে এবং মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসছে। ওদিকে মৌমাছিরা সারাক্ষণ মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ফুলের বনে অলিরা গুণগুণ করছে। এদের গুঞ্জনে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা মেলে উড়তে লাগল মনের সুখে।
বিকেলে, তারা তাদের প্যারেড শুরু করল। আগে পল্লবী নিজেকে ফুলের রাজকুমারী সাজালো। এরপর তারা সবাই একসঙ্গে ফুলের প্লেকার্ড নিয়ে পুকুরের চারপাশে ঘুরতে লাগল।
পল্লবী দেখল সেখানে রুমার দাদুও দেখতে এসেছে। রুমা জিজ্ঞেস করল বসন্তর কি কি ভালো লাগে তোমার?
দাদু বলল, বসন্ত ঋতু সবদিক থেকে জনজীবনের জন্য নিরাপদ সময়। এ সময় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো যায়। লেপ-কাঁথা ছাড়া শোয়া যায় যেখানে খুশি সেখানে। প্রকৃতির কাছে এ নিরাপত্তা পেয়ে মানুষ বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় ধর্মসভা ও মেলা। বিবাহ অনুষ্ঠান ও বউভাতের আয়োজন হয় শহর-গ্রামে সর্বত্র। বছরের সব মেলামোদিনী গান সার্কাসের আয়োজন হয় এ ঋতুতেই। উন্মুক্ত আকাশের নিচে পসরা সাজিয়ে বসে কত দোকানপাট।
বসন্তের বাতাসে যেন আনন্দের সুর ভেসে আসছিল। গ্রামের লোকেরা তাদের দেখে হাততালি দিচ্ছিল এবং গাইছিল, ‘বসন্ত এসেছে, আনন্দের মেলা!’
তারা যখন প্যারেড শেষ করলো, তখন পল্লবী ভাবলো, ‘এখন আমাদের ছোট্ট একটি খেলা খেলতে হবে। আমরা সবাই মিলে বসন্তের নতুন ফুলের মালা বানাবো।’
তারা সবাই মিলে ফুলগুলোকে একত্রিত করে একটি সুন্দর মালা তৈরি করতে লাগল। সেই মালা পরে তারা সবাই একসঙ্গে বসে গান গাইলÑ‘আহা আজি এ বসন্তে কত ফুল ফুটে, কত পাখি গায়…’
তাদের আনন্দ দেখে গ্রামের সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। বড়রা ও শিশু-কিশোররা মিলে নাচ-গান করতে লাগলো। পুরো গ্রামে এক উৎসবের আমেজ তৈরি হলো। দখিনা বাতাসের মৃদুদোলা তাদের দেহ ও মনের ক্লান্তি জুড়িয়ে দেয়। বসন্তের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তাদের প্রাণকে চঞ্চল করে তোলে। নবজাগরণের দোলা লেগে বাংলার প্রকৃতির সাথে সাথে তাদের হৃদয়ও যেমন শিহরিত হয়; তেমনি অজানা এক সুরের প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে হৃদয়।
সন্ধ্যার পরে, যখন সূর্য ডোবার সময় হলো, পল্লবী দেখলো, তার বন্ধুরা একসঙ্গে বসে বসন্তের গল্প বলছে। তারা বসন্তের জাদু নিয়ে কথা বলছিল। পল্লবী বলল, ‘বসন্ত শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, এটা আমাদের জীবনের জন্যও। আমাদের মাঝে প্রেম, বন্ধুত্ব আর সুখ এনে দেয়। আসুন, আমরা আমাদের জীবনেও বসন্তের জাদু নিয়ে আসি!’
সবাই একমত হয়ে পল্লবীর কথায় সায় দিল। তারা বুঝতে পারলো, বসন্ত আসলে এক নতুন শুরু, যা আমাদের সবসময় মনে করিয়ে দেয়, জীবন কত সুন্দর হতে পারে। কেননা বসন্ত প্রকৃতিতে ফুল ফোটায়, পত্রঝরা বৃক্ষে নবপল্লবের আশীর্বাদ বয়ে আনে, শুষ্ক মৃত্তিকাতে জাগায় কচি কিশলয়। শীতের অসুস্থ প্রকৃতিকে সে দান করে সুস্থতা, তৃণপল্লবও পত্রপুঞ্জে সমৃদ্ধ করে প্রকৃতিকে।
রাতুল জিজ্ঞেস করেÑ আমাদের জন্য বসন্ত কী দেবে?
তাহলে শোন, বসন্ত আমাদেরকে দেবে ব্যক্তিত্ব, সুস্থ করে তুলবে চিন্তার অসুস্থতা। অলসতা, অকর্মণ্যতা, নৈতিক অধঃপতন আমাদের চিন্তার অসুখ। এগুলোই আমাদের জীবনের জীর্ণতা, পঙ্গুতা ও আড়ষ্টতা আনে। আমরা সেদিনের জন্যই অপেক্ষা করব, যেদিন প্রকৃতির বসন্তের সঙ্গে আমাদের জীবনেও বসন্তের আগমন ঘটবে। মিথ্যা, প্রবঞ্চনা ও অসততা হতে যেদিন আমরা মুক্ত হতে পারব; সেদিনই আমাদের জীবন ফুলের পাপড়ির মতো শোভা ও সৌন্দর্যে ভরে উঠবে। আর সেদিনই সূচিত হবে আমাদের জীবনের বসন্ত।
পল্লবী এবং তার বন্ধুরা সেই সন্ধ্যায় উপলব্ধি করল, ‘বসন্তের সুখ, বন্ধুত্বের খুশি-এটাই আমাদের জীবনের মূল ধারা।’
এইভাবে ফুলনগরের ছোট্ট মেয়েটি এবং তার বন্ধুরা বুঝতে পারলো, প্রকৃতি ও বন্ধুত্বের মধ্যে যে জাদু, সেটাই আসলে বসন্তের আসল অর্থ। তাদের হাসি, গান, আর আনন্দে পুরো গ্রামটি ভরে উঠলো, এবং বসন্তের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। এভাবে শিশুকিশোরের ছোট্ট মনোজগতে বসন্তকাল বৃহৎ বৃহৎ কল্পনা ও স্বপ্নের জন্ম দিলো। জীবনকে রঙিন ও মধুর করে ভাবতে শিখালো। এমনই মুহূর্তে পল্লবীর মনে জাগে কত কথা, কত গানÑ ‘আজি এ বসন্ত সমীরণে/কত কথা মোর মনে পড়ে।’