মনসুর নাদিম :
কলিং বেলের শব্দে নড়েচড়ে বিরক্তি প্রকাশ করে শায়লা। পর পর দুবার বেল বাজার পর শামীম কোন রকমে শরীরটাকে টেনে তুলে বিছানায় বসেছে। এর মাঝে আবারও বেজে উঠল ডোর বেলটা। হাই তুলতে তুলতে শামীম কিচেন থেকে দুধের পাত্রটা নিয়ে দরজা খুলে দেখে জব্বারের জায়গায় এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে দুধের কলস নিয়ে। শামীমের মেজাজটা খারাপ ছিল। জব্বারকে বার বার করে বলা হয়েছে শুক্রবারে একটু দেরিতে দুধ দিও। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। শায়লারও অফিস নেই, অনিকের স্কুল নেই, শামীমের অফিসও বন্ধ। তাই সপ্তাহের এইদিনটা একটু বেলা করেই সবাই উঠে। কিন্তু আজ জব্বার আসেনি। খুব করে রেগে ছিল শামীম। কপাল ভালো বেঁচে গেছে। নইলে আজ কড়া কী, সেন্সর ছাড়া শব্দ বোমা ছুঁড়ত শামীম। এমনিতেই আজকাল সেফুদা সেফুদা ভাব। যুতসই স্থান কাল পাত্রের অভাবে শব্দবোমাগুলি ফাটানো হয় না। ইউটিউবে সেফুর মাতলামিগুলি লুকিয়ে লুকিয়ে শামীম দেখে আর মিটিমিটি হাসে। শায়লা দেখলে রক্ষা নেই। সেফুদা শায়লার একদম পছন্দ না। বুড়ো খচ্চর বলে গালি দেয় শায়লা। তুমি জব্বারের মেয়ে ? শামীম দুধওয়ালি কিশোরীকে জিজ্ঞেস করে। কলস থেকে দুধ ঢালতে ঢালতে জবাব দেয়- জ্বি, শামীম অপলক তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। তোমার নাম কী ? পড়ালেখা করো ? দুধের পাত্রটা এগিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল- আসমা আমার নাম। ক্লাস এইটে পড়তাম চৌধুরী স্কুলে । মাথা নীচু করে কথাগুলি বলল আসমা। শামীম খানিকটা এগিয়ে দুধের পাত্র নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো- পড়তাম মানে, এখন পড় না ?
না, বাবা পড়ার খরচ চালাতে পারছে না। তাছাড়া
তা ছাড়া কী ?
শামীম- এই শামীম, কে ওখানে ? ভেতর থেকে শায়লার ডাক। শামীম ভিতুর ডিমের মতো মিনমিনে গলায় বলে উঠলো- না কেউ না। দুধ নিচ্ছিলাম। আসমাকে হাতের ইশারায় দাঁড়াতে বলে দুধ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। শায়লা বালিশটা টেনে আরাম করে উরু সন্ধিতে গুঁজিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে। শামীম পা টিপে টিপে কিচেনে দুধের পাত্রটা রেখে খুবই সতর্কতার সাথে ড্রয়ার খুলে দুধের বিলের টাকা কটা গুনে নিয়ে চোরের মতো পা টিপে টিপে দরোজার দিকে গেল । আসমা দাঁড়িয়ে আছে। আজকাল ভয় ভয় লাগে। এই সাত সকালে বাসায় কে আছে কে নেই বোঝা মুশকিল। ভাগ্যিস শায়লার আওয়াজ শুনছিল। এই সমাজের পুরুষ গুলো কেমন যেন পশুর চেয়েও অধম হয়ে গেছে। ষাট বছরের বৃদ্ধা থেকে শুরু করে ছয়মাসের শিশু পর্যন্ত ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। চারিদিকে মানববন্ধন হচ্ছে, প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি করা হচ্ছে। ভয়ে জব্বার আসমাকে স্কুলে যেতে না করে দিছে। টিভির খবরে আসমা দেখে শিক্ষকেরা ছোট ছোট শিশুদের ধষণ করেছে বলে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোন কোন মাদ্রাসার হুজুরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে শিশু বলাৎকারের অভিযোগে। আসমা জানে না বলাৎকার কী ? ধষণ তো সে বোঝে। কেউ ধর্ষণের আলোচনা করলে সে লজ্জায় সরে যায়। কিন্তু পুরুষ ছেলেদের সাথে বলাৎকার কী সে বোঝে না। শামীম সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করবে নাকি ? শামীম দুধের বিলের টাকা কয়টা আসমার চোখের সামনে বার বার গুনছে। দেন, আমি যাই। টাকার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল আসমা। দাঁড়াও না, স্কুলে যাওনা কেন তাতো বললে না। শামীম অহেতুক টাকা গুনতে গুনতে জিজ্ঞাসা করলো।
আব্বাই ভয় পায়। আমরা গরিব মানুষ বদনামি হয়ে গেলে কয় বিয়া অইব না।
কেন ভয় পাবে, আরও মেয়েরা পড়ছে না ?
ওদের চিন্তা নাই। ওরা পয়সাওয়ালা লোক।
তোমারও কিছু হবে না। এখন মৃত্যুদ-ের আইন হইছে ।
হি হি হি, কিছু হবে না আপনি গ্যারান্টি দিতে পারবেন ?
আসমার কথা শুনে শামীম আমতা আমতা করে বলল- গ্যারান্টি তো কোন কিছুরই নেই। হা হা হা । ভেতর থেকে চুল বাঁধতে বাঁধতে শায়লা এসে শামীমের পেছনে দাঁড়াল।
কী ব্যাপার, জব্বর আসে নাই ? তুমি জব্বরের মেয়ে ?
জ্বি আপা।
তোমার বিয়ের কথা বলছিল জব্বর।
জ্বি না আপা, আমার না। আমার আপুর ।
আচ্ছা আচ্ছা । বিয়ে ঠিক আছে তো নাকি ? ছেলেকে টাকা কত দিতে হবে ? কী বলছো , টাকা দিয়ে বিয়ে ? শামীম আর্তনাদ করে উঠলো যেন।
ছোটলোকদের বিয়েতে টাকার লেনদেন হয়। ফিসফিস করে বলল শায়লা। আসমা তাদের কথা পুরো শুনতে না পেলেও বুঝতে পেরেছে কথাটা তার না শোনাই ভালো। চারিদিকে কত মানুষ। সব মানুষের সব কথা শুনতে হয় না। মেয়েটার উজ্জ্বল শ্যামলা গাত্রবর্ণের সাথে চেহারাটা দারুণ । শামীমের বড় ভালো লেগেছিল মেয়েটাকে। বিধাতাও গরিবের অভাবের সংসারে চাঁদের টুকরোগুলি দেয়। আজ সকালটা চমৎকার ছিল। জব্বরের মেয়েটার টানা টানা হরিণের মতন চোখ। দুই মোটা ভ্রƒ এসে নাকের গোড়ায় যুক্ত হয়েছে। গোলাপি ঠোঁটের ফাঁকে মুক্তোর মত দন্তপাটি । শামীমের আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে মন চাইছিল। কিন্তু শায়লা এসে সব এলোমেলো করে দিল। এই নাও গতমাসের দুধের বিল । শামীম টাকাগুলো এগিয়ে দিল । শায়লা চেঁচিয়ে উঠলো, এই দাঁড়াও দাঁড়াও, দুধের বিল তো দশ তারিখের পর , আজকে এত তাড়াতাড়ি দিচ্ছ কেন ? ছোঁ মেরে টাকা কটা কেড়ে নিল শায়লা। আসমা টাকার জন্য হাত বাড়িয়েও হাতটা ওখানেই থেমে গেল।
কী আশ্চর্য ! টাকা যখন দিতে হবে, আজ দিই কাল দিই দিয়ে দিলেই চুকে গেল।
দিয়ে দিলেই চুকে গেল । ভেংচি কেটে শায়লা বলল। নিয়ম নিয়ম । দশ তারিখ বিল দেয়ার টাইম দশ তারিখই দেয়া হবে।
আচ্ছা এত নিয়ম নিয়ম করে কী হবে, দেশের কোন জিনিসটা নিয়মে চলছে বল দেখি ?
আমরা নিয়ম মানার অভ্যাস করলে তবেই নিয়ম মানার সংস্কৃতি চালু হবে সমাজে। আসমা হাসে। দুধের কলসটা হাতে নিয়ে বলে, থাক থাক আপু। টাকা আব্বুই নেবে। আমি দুধ দিতেই এলাম। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল আসমা। ভাবতে লাগলো মেয়েদের মন এত ছোট হয় কেন ? আর এই আপু তো টিভিতে দেখা সেই নারীবাদী আপুদের মতো দেখতে। যারা টিভিতে নারীদের অধিকার নিয়ে বড় বড় লেকচার দেয় । ধর্ষকদের মৃত্যুদ- চাওয়া হলে কেউ কেউ মিনমিনে গলায় মানবাধিকারের দোহাই দেয়। আরে বাবা, মানবাধিকার তো মানুষের জন্য। কোন পশুর জন্য নয়। মনে মনে বিড়বিড় করে ফুটপাত ধরে হাঁটছে আসমা । আজকাল ফুটপাত কিছুটা দখলমুক্ত হয়েছে। মহিলাটা না এলে লোকটার কাছে জিজ্ঞেস করতো আসমা ‘ বলাৎকার’ মানে কী । শিক্ষিত মানুষ অবশ্যই জানবে। বাবা খবর শুনে গজগজ করে শুধু বলেছিলেন- জাহান্নামী কওমে লুত। এটার অর্থও আসমা বোঝেনি। অনেকক্ষণ রোদের মধ্যে হেঁটেছে আসমা। প্রায় বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে। বলাৎকার কারে কয়, বলাৎকার মানে কী এখনো জানতে পারেনি আসমা। এই শব্দটার অর্থ জানার দারুণ ইচ্ছা তার। কিন্তু কার কাছে জিজ্ঞেস করবে ? মনে পড়ল তাদের বাসার পেছনের বিল্ডিংয়ে থাকেন সুরাইয়া ম্যাডাম। অনেক আদর করে আসমাকে, আসমা তার কাছেই যাবে।
সকাল সকাল আসমাকে দেখে অবাক হলেন সুরাইয়া ম্যাডাম।
কী ব্যাপার সকাল সকাল । কোন খারাপ খবর নয় তো ?
না মেম, কয়েকদিন একটা জিনিস বুঝতেছি না। কারো কাছে জিজ্ঞেসও করার সাহস পাচ্ছি না। শেষে ভাবলাম, আপনি আমার শিক্ষক আপনার কাছ থেকে শেখা যায়।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে বলো কী এমন বিষয় জানতে চাচ্ছো । ম্যাডামের কথা শেষ হলে আসমা ইতস্তত করতে লাগলো।
ম্যাডাম বাসায় আর কেউ নেই ?
আছে, কেন বলো তো । তোমাকে নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন ?
না না মেম, আমি ঠিক আছি ।
ঠিক থাকলে তোমার প্রশ্ন করো। কলসে দুধ আছে ? তোমার আব্বু এখনো সুস্থ হয়নি ? বলো বলো কী জানতে চাও । তাড়াতাড়ি বলো । আমার কাজ আছে। আসমা ঢোক গিলে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
মেম, বলাৎকার মানে কী ?
প্রশ্ন শুনে সুরাইয়া ম্যাডাম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো আসমার বোকা বোকা চেহারার দিকে। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- এই শব্দটার সাথে আমাদের মেয়েরা তেমন পরিচিত না। তাই তুমিও জানো না এর মানে কী । এটা পুরুষে পুরুষে সঙ্গম । যাকে বিকৃত রুচি বলা যায় । এটা এমন একটা পদ্ধতি একমাত্র মানুষের মাঝেই তা প্রচলিত। প্রকৃতির অন্য কোন প্রাণির মাঝে তা নেই। আসমার চোখের পাতা ভিজে গেল ।