বন্দরের উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ

চট্টগ্রাম বন্দরের ছবিটি তুলেছেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকী

বিশেষ প্রতিবেদন »

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এই বন্দরের চারটি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় গুছিয়ে এনেছে অন্তবর্তী সরকার। এ বছরে অন্তত দুটি টার্মিনাল এবং আগামী বছর দুটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।

সরকার চাইছে, চারটি টার্মিনাল দ্রুত বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে। তাতে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। আবার বন্দরের দক্ষতাও বাড়বে। তবে সমালোচনাকারীরা বলছে, বন্দর পরিচালনা স্পর্শকাতর বিষয়। এজন্য রাষ্ট্রীয় কিংবা দেশীয় বেসরকারি খাতের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত। যদিও দেশে বেসরকারি খাতে বন্দর পরিচালনায় আন্তর্জাতিকমানের প্রতিষ্ঠান নেই।
বাংলাদেশে কনটেইনার সুবিধার বন্দর বলতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। মোংলায় খুব সামান্য সুবিধা রয়েছে কনটেইনার পরিবহনের। পায়রাতে কনটেইনার পরিবহনের কোনো সুবিধাই তৈরি হয়নি। অর্থাৎ কনটেইনার সুবিধার বন্দর প্রকল্পের সব সম্ভাবনা রয়েছে চট্টগ্রাম ঘিরে। বিগত সরকারের সময়ে পায়রাতে মনোযোগ দেওয়া হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদে চট্টগ্রামে টার্মিনাল নির্মাণের জোর দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
চট্টগ্রাম বন্দরে এখন চারটি টার্মিনাল চালু আছে। এই চার টার্মিনাল হলো নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি, চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল বা সিসিটি, জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবি এবং পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বা আরএসজিটি চিটাগং। এই চার টার্মিনালে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারে ৯৯ শতাংশ ওঠানো-নামানো হচ্ছে। এর মধ্যে এনসিটি পরিচালনা করছে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড়্রাই ডক লিমিটেড, সিসিটি পরিচালনা করছে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড এবং জিসিবির ছয়টি কনটেইনার জেটি পরিচালনা করছে ছয়টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। আরএসজিটি চিটাগং হলো প্রথম বিদেশিদের হাতে দেওয়া টার্মিনাল।
বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় এখনো টার্মিনালের সংখ্যা কম। ফলে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এক দশক আগে থেকে। তবে এ সময়ে শুধু একটি টার্মিনাল চালু হয়েছে। এটি হলো পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। গত বছর চালু হওয়া এই টার্মিনালটি বন্দরের বহরে যুক্ত হওয়ার পরও বন্দর জাহাজজটে পড়েছে। নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করে বন্দর সুবিধা বাড়ানো ছাড়া জাহাজজট থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই বলে ব্যবহারকারীরা মনে করেন। এমন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণের চাহিদা তৈরি হয়েছে।
ব্যবসায়ী সমাজের এমন চাপ থেকে কনটেইনার পরিবহন সামাল দিতে তৎকালীন সরকার জাপানের আর্থিক সহায়তায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প হাতে নেয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সমাজের চাপে বে টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ শুরু করে। দীর্ঘমেয়াদে এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে মধ্যমেয়াদে চাপ সামাল দিতে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ও লালদিয়ার চর কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প হাতে নেয় তৎকালীন সরকার। এর মধ্যে শুধু পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প চালু হয়। বাকিগুলো এখনো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।
এখানে উলেখ করা দরকার, বন্দর দিয়ে শুধু কনটেইনার নয়, সাধারণ পণ্য ও তেল পরিবহনকারী জাহাজের পণ্য পরিবহন হয়। তবে কনটেইনার জাহাজ ছাড়া অন্য পণ্যের বড় অংশই সাগরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে স্থানান্তর করে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবহন করা যায়। নির্ধারিত গন্তব্যেও ছোট ছোট ঘাটগুলোতে নিয়ে খালাস করা যায়।
তবে কনটেইনার জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো বা রপ্তানি কনটেইনার জাহাজে ওঠানোর মত কাজ ক্রেন ও জেটি ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে কনটেইনার জাহাজের জন্য জেটি ও যন্ত্রপাতি খাতে বিপুল বিনিয়োগের দরকার হয়।
কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের গুরুত্বের বড় কারণ হলো বাংলাদেশে সমুদ্রপথে রপ্তানির পুরোটাই কনটেইনারে পরিবহন হয়। আবার কনটেইনার আমদানি হয় পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পখাতের কাঁচামাল। ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ও মূল্যবান পণ্যও কনটেইনারে আনা হয়। এমন বাস্তবতায় কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠছে বাংলাদেশেও। বিদেশিদের আগ্রহকে কেন্দ্র করে সরকার কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করে।

বিদেশিদের হাতে যাচ্ছে কোন টার্মিনাল
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বন্দরের মোট পাঁচটি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সবকটি টার্মিনালের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় জি টু জি ভিত্তিতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া ঠিক হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ আমলের শেষদিকে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া হয়। এখনো টার্মিনালে পুরো বিনিয়োগ হয়নি।
গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। বাকি চারটি টার্মিনালের কাজ তারা এগিয়ে নিতে থাকে। এই চারটি হল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল, লালদিয়ার চর টার্মিনাল এবং বে টার্মিনাল প্রকল্পের দুটি টার্মিনাল।
এই চারটির মধ্যে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পুরোপুরি চালু রয়েছে। এই টার্মিনালটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ নিয়ে আন্দোলনও করেছে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল চট্টগ্রাম বন্দর শাখা। তাদের যুক্তি হল, এই টার্মিনাল এখনই ভালোভাবে চলছে। টার্মিনালটিতে সব ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। ফলে এই টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে না দিয়ে যেখানে বিনিয়োগ হবে সেগুলোতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করা দরকার। আবার নিউমুরিং টার্মিনালে কত বিনিয়োগ হবে, কোথায় বিনিয়োগ হবে তা এখনো স্পষ্ট করেনি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।
অপর তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করে পরিচালনা করতে হবে। এর মধ্যে লালদিয়ার চর টার্মিনাল নেদার‍ল্যান্ডসের এপিএম টার্মিনালসের হাতে, বে টার্মিনালের একটি সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং আরেকটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই তিন টার্মিনাল নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি খাতে অবশ্য বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। এর মধ্যে লালদিয়ার চরে ৪০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হতে পারে। বে টার্মিনালের প্রতিটিতে ১০০ কোটি ডলার বা এক বিলিয়ন করে বিনিয়োগ আসবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বন্দর পরিদর্শনে এসে জানিয়েছেন, এ বছরেরই প্রকল্পগুলোতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ হবে।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ডিসেম্বরের মধ্যে বন্দরগুলোতে আমরা কিছু রূপান্তর করে দিয়ে যেতে চাই। কিছু চুক্তি সই করে দিতে চাই। এমন একটা জায়গায় আমরা নিয়ে যাবো, যেখানে চাকা ঘোরানো শুরু করে দিলে এরপর এই চাকাটা থামানো সম্ভব হবে না। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার আসবে। তাদের থিতু হতে সময় লাগবে। ওই সময়ে যাতে কোনো কাজ থেমে না থাকে, সে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।’
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, এই চারটির মধ্যে লালদিয়ার চর কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি বিনিয়োগকারী এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে প্রথম চুক্তি হতে যাচ্ছে। এরপরের চুক্তি হবে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের। নিউমুরিংয়ের সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর। প্রকল্প দুটির ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার (পিপিপি কর্তৃপক্ষের পক্ষে নিয়োগ করা সংস্থা) বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)’ থেকে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে।
তবে বে টার্মিনাল প্রকল্পে এখনো প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি। ফলে বে টার্মিনাল প্রকল্পের দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় এ বছর চুক্তি হচ্ছে না। তবে আগামী বছর চুক্তি হতে পারে।
বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি হলে তারা দীর্ঘমেয়াদে (২৫-৩০ বছর) টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এ সময়ে তারাই মাশুল আদায় করবে। সেখান থেকে বন্দরকে একটা অংশ দেবে টার্মিনাল পরিচালনাকারীরা। সেটা কত হবে তা চুক্তির মাধ্যমে ঠিক হবে। তারা টার্মিনাল নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি খাতে যে বিনিয়োগ করবে তা এভাবে ওঠিয়ে আনবে। আবার মুনাফাও করবে।

মাতারবাড়ী কখন আসবে? কীভাবে পরিচালনা?
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় প্রকল্প কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল প্রকল্প। ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন’ নামে প্রকল্পটি ২০২০ সালের মার্চে নেওয়া হয়। ২০২৬ সালের মধ্যে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন তা পিছিয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরে করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে টার্মিনাল চালু হবে ২০৩০ সাল থেকে। সংশোধনের পর প্রকল্পের মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। এটি প্রাথমিক খরচ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা থেকে ছয় হাজার ৬০৪ কোটি টাকা বেশি।
মাতারবাড়ীর প্রথম টার্মিনালে থাকবে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি কনটেইনার জেটি ও ৩৩০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি মাল্টি পারপাস জেটি। অন্য সব প্রকল্পের চেয়ে মাতারবাড়ীর গুরুত্ব হলো, এই বন্দরে কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ ভিড়ানো যাবে। সেক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকার বন্দরের ওপর নির্ভর থাকতে হবে না। মাতারবাড়ী থেকে সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকায় জাহাজ চলাচল শুরু হবে। এতে করে কম সময়ে রপ্তানি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকায় নেওয়া সম্ভব হবে। জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, মাতারবাড়ীতে ৮ হাজার ২০০ একক কনটেইনার পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
জাপান, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে মাতারবাড়ী প্রকল্প চালু হলে পাল্টে দেবে বাংলাদেশের বন্দর খাত। কারণ প্রথমবারের মত গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল হচ্ছে মাতারবাড়ীতে। অবশ্য শুরুতে টার্মিনালটি বন্দর নিজেরা পরিচালনার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে এখন বিদেশিদের নজর পড়েছে টার্মিনালটিতে। যদিও এখন পর্যন্ত টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে দেওয়া হবে কি-না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

বন্দর খাতে বিদেশিদের আগ্রহ কেন এত বেশি?
বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক খাত রয়েছে। রপ্তানিমুখী লাভজনক পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় বন্দর খাতে বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রহ বেশি।
এর কারণ হিসেবে বন্দর খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের ৯৯ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি আঞ্চলিক বাণিজ্য ও ট্রানজিট হাব হয়ে উঠতে পারলে এটি হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় আকর্ষণ।
বিশেষ করে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে আধুনিক গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ সব ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। টার্মিনালটিতে বছরে প্রায় ১৩ লাখ কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে। দক্ষতা ও অবকাঠামো ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হওয়ায় বৈশ্বিক অপারেটররা এটি লাভজনক সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে।
নতুন যেসব টার্মিনাল নির্মাণ করে পরিচালনা হবে সেগুলোও দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক। ফলে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় এগিয়ে এসেছে অপারেটররা।
সবমিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের মূল কারণ হলো এর কৌশলগত অবস্থান, আধুনিক অবকাঠামো, উচ্চ মুনাফার নিশ্চয়তা, বিশ্বে প্রচলিত বন্দর পরিচালনা মডেলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবিধা।

বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধা কী?
বন্দর খাত সংস্কারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদেশি বিনিয়োগের জোয়ার শুরু হয় নব্বই দশকে। এ সময়ে ভারত ও পাকিস্তানে বিদেশি অপারেটররা টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পায়। সুফলও পেয়েছে দেশ দুটি। বাংলাদেশে নব্বই দশকে ও এ শতাব্দীর প্রথম দশকে বিদেশি বিনিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি।
বাংলাদেশে এখন যেসব বিদেশি অপারেটর আসছে সবগুলোই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। সিঙ্গাপুরের পিএসএ টার্মিনালস বিশ্বের টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে এক নম্বরে রয়েছে। ডিপি ওয়ার্ল্ড ও এপিএম টার্মিনালস বিশ্বেও সেরা পাঁচ টার্মিনালের মধ্যে রয়েছে। এসব অপারেটর বিশ্বেও যেসব জায়গায় টার্মিনাল পরিচালনা করছে সেখানে তারা দক্ষতার ছাপ রেখেছে। অর্থাৎ নিজেদের ব্যবসা ঠিক রাখতে হলে তাদের দক্ষতার সেরাটা দিতে হবে।
বাংলাদেশে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ হলে বন্দর খাত আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে। আবার বিদেশি বিনিয়োগও আসবে। লোকবলের বড় অংশই নিয়োগ হবে বাংলাদেশের। ফলে এখানে যেমন বন্দরের দক্ষ লোকবলের সংখ্যা বাড়বে। আবার সেবার মান ভালো হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে গতি আসবে। পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম দ্রুত হলে খরচও কমে আসবে।
বন্দর ব্যবহারকারী পোশাক খাতের একজন উদ্যোক্তা জানান, বিদেশিরা মুনাফা করবে – তাতে সন্দেহ নেই। তবে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে তাদেও সেবার মান বাড়লে পোশাক খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এগিয়ে যেতে পারবে।
বাংলাদেশে বন্দর খাতে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান নেই। শুধু বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান নয়, বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মত প্রতিষ্ঠানও নেই। ফলে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করছে সরকার।

কোন পথে যাচ্ছে বন্দর উন্নয়ন?
ভৌগলিক ও আঞ্চলিক কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হওয়ার নজির রয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালে চীনের আর্থিক সহায়তায় সোনাদিয়া প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ভূরাজনৈতিক কারণে এই প্রকল্প থেকে পিছিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে। সোনাদিয়া বাতিল হওয়ার পর কনটেইনার পরিবহনের চাপ সামলাতে মধ্যমেয়াদে দরকার ছিল চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ছোট ছোট টার্মিনাল নির্মাণের। তবে তৎকালীণ আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রামের পরিবর্তে পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প হাতে নেয়। কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে এই প্রকল্পে এখনো কোনো টার্মিনাল নির্মাণ হয়নি।
সেই সময়ের সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো হাতে নেয়, যার একটি বিদেশি বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এটি হলো সৌদি আরবের রেড সী গেইটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল।
বন্দর খাতের ব্যবহারকারীরা বলেন, যেসব প্রকল্পে এখনো কোনো অবকাঠামো হয়নি সেগুলোতে বিদেশি অপারেটরদেও দেওয়া হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব অপারেটরদের দক্ষতাও আন্তর্জাতিকমানের। বির্তকের কারণে যাতে বন্দরের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আবার বন্দরের সব টার্মিনাল যাতে বিদেশিদের হাতে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ সব টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে গেলে দেশীয় অপারেটর উঠে আসার সুযোগ কমে যাবে। যদিও এখনো বন্দরের দুটি টার্মিনাল দেশীয় অপারেটরের হাতে রয়েছে, বিদেশিদের হাতে দেওয়ার পরিকল্পনা নেই সরকারের। বে টার্মিনাল প্রকল্পের তৃতীয় টার্মিনালও বন্দর নিজেরাই নির্মাণ ও পরিচালনার সিদ্ধান্ত রয়েছে।