অরূপ পালিত »
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ লিখেছিলেন :
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে …
জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কবিতাটি আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য। মায়ের কবিতার মতো কথায় না, কাজে বড় হয়ে দেখালেন ‘রূপসী বাংলা’র কবিখ্যাত জীবনানন্দ দাশ। তিনিও রহস্যময় ‘’বনলতা সেন কবিতাটির জন্য ভীষণ জনপ্রিয়। এই কবিতার রহস্য-উৎস উদঘাটন করতে পাঠকের হৃদয় প্রতিনিয়ত খেলা করে। যুগে-যুগে নানান কোতূহলী ভাবনা বনলতাকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে। কেনই বা জীবনানন্দ দাশ বনলতার মাঝে দুদণ্ড শান্তি খুঁজেছেন! পেয়েছিলেন? এ কথার রহস্য বেড়াজালে আবদ্ধ এখনো সবাই।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে বাংলা কবিতার বরপুত্র জীবনানন্দ দাশের কবিতার হৃদয়ে নারীর অনবদ্য রূপ প্রতিনিয়তই তাঁর সুরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাঁর কল্পনার মিথ শ্যামলী থেকে সুরঞ্জনা বা সবিতা, শ্যামলী, সুদর্শনা যে নামেই অভিহিত হোক না। বারেবারে বনলতার মাঝে ফিরে গেছেন কবি। কবির মনোজগতের প্রেয়সী এই ষোড়শীকন্যা বনলতাকে নিয়ে মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম নেয় ক্ষণে-ক্ষণে।
সব পাখি ঘওে ফিরে- সব নদী- ফুরায় এ জীবনের
সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
একথার মানে কী? কবি তাহলে শান্তির নীড়ে ফিরেছিলেন? এতো প্রশ্নের উত্তর পাই কী করে? কে ছিল আসলে এই বনলতা! তিনি কী নাটোরের রানি? অনেক গুণী লেখকের কলমের ছোঁয়ায় একেক রকম করে ওঠে এসেছে বনলতার কথা। জীবনের সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরও নতুন করে শুরু করার নামই জীবনানন্দ। জীবনানন্দের বিশাল হৃদয়জুড়ে বনলতার জায়গা। তাহলে বনলতা কেমন ছিলেন?
সেই বনলতা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। কুড়ি-বাইশ বছরের আগে সে এক পৃথিবীতে; বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল সে। তারপর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক নতমুখে মাঝপথে গেল থেমে। তারপর খিড়কির পুকুরের কিনারা দিয়ে, শামুক গুগলি পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভিতর দিয়ে চলে গেল সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে একবার দাঁড়াল। তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর তাকে আর আমি দেখেনি।
অনেকদিন পর আজ আবার সে এলো। মনপবনের নৌকায় চড়ে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে। চিকন চুল ঝাড়তে-ঝাড়তে সে এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। মিষ্টি, অশ্রুমাখা চোখ। ঠান্ডা, নির্জন দুখানা হাত। ম্নান ঠোঁট, শাড়ির ম্নানিমা নিয়ে। সময় থেকে সময়ান্তর, নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে তার যাত্রা। ১৯৩৪ সালে জীবনানন্দের উপন্যাস ‘কারুবাসনা’তে বনলতা ছিলেন। ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশ : পাণ্ডুলপি’তেও কবিতা-২ অনুসারে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির রচনাকাল ১৯৩৪ সাল। কবির বেশ কিছু কবিতায় বনলতা বারেবারে ফিরে আসেÑ
এক.
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভনগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন;
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
দুই.
শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন-
কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে
হিজল-জামের বনে
থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন
নিশুতির বনলতা সেন।
তিন.
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো;
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না- দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো দ্বারকার, দাঁড়ায়ে রয়েছে নত, ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন
‘মনে আছে?’ সুধালো সে-
শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?’
বনলতাকে নিয়ে গবেষণা করছেন অনেক গুণীজন। তবে রহস্যের জট খুলতে পেরেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’Ñ এখানে কবির কবিতার বিষণ্নতার ছাপ দেখে নাটোরে বেড়াতে আসা কে এম আবদুস সালাম বনলতাকে নিয়ে কয়েকটি গল্পও বের করেছেন। জীবনানন্দ দাশ ব্যক্তিগত কাজে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। দার্জিলিং মেইল তখন নাটোর হয়ে যেত। নাটোর স্টেশন থেকে এক বৃদ্ধের সাথে ওঠেন এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। বৃদ্ধের নাম ছিল ভুবন সেন। ভুবন সেনের সাথে সুন্দরী যে মেয়েটা ছিলেন তিনি তাঁর বিধবা বোনÑ বনলতা সেন। ভুবন সেন ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জেগে ছিলেন জীবনানন্দ দাশ আর বনলতা সেন। একসঙ্গে অনেকখানি সময় কেটে যায়। মাঝপথে একসময় কোনো এক স্টেশনে বনলতা নেমে পড়েন। তাহলে এই কিছুক্ষণ সময়ের আলাপকালে কবির মনে বনলতা কি বিষণ্নতার ছাপ রেখে গেলেন?
কবি বনলতা সেনের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যদি থাকতেন, তাহলে ‘মোনালিসা’র মতো হয়তো বনলতার ছবিও সৃষ্টি হয়ে যেতো তাঁর হাতে।
আসলে বনলতাকে কেউ কি দেখেছিলেন? না দেখলেও কবির কবিতার বর্ণনাটি ছবির জন্য যথেষ্ট নয় কী?
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
বনলতাকে নিয়ে পাঠকের হৃদয়ে যে ছবিটি এঁকে দিয়েছেন কবি জীবনানন্দ মোনালিসার হাসির মতো অদৃশ্য সেই বনলতার এক চিলতে হাসির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাজার বছর লেগে যাবে। বনলতাকে নিয়ে আরও অনেক কাহিনি রয়েছে নাটোরের রাজবাড়িতে। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানি ভবানীর রাজপ্রাসাদে গুণীজনদের নিয়মিত আসা-যাওয়া চলতো। তখনকার সময়ে নাটোরের কোনো এক রাজার আমন্ত্রণে রাজবাড়িতে আসেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কবির দেখাশোনা করেন সুন্দরী কয়েকজন পরিচারিকা। সেখানে এক সুন্দরী পরিচারিকার প্রতি কবির মমতা জেগে ওঠে। তাঁকে নিয়ে লিখতে চেয়েছেন কবিতা। ওই নারী লোকলজ্জার ভয়ে কবিকে অন্য কোনো ছদ্মনামে কবিতা লিখতে অনুরোধ করেন। রোমান্টিক কবি তাঁর মনোজগতের প্রেয়সীর ছদ্মনাম ব্যবহার করেনÑ ‘বনলতা’।
আকবর আলি খান বলেছেন, বাংলা কবিতার সবচেয়ে জনপ্রিয় নারীচরিত্র বনলতা সেনকে নিয়ে পাঠকের কৌতূহলের শেষ নেই। এই বনলতা সেন কে? সে কি বাস্তব কোনো নারী না সম্পূর্ণ কাল্পনিক? এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।
কবি কখনও নিজের অজান্তেও এই বিষয়ে কারো কাছে কিছু বলেননি। কবি নীরব থাকলেও যুগ-যুগ ধরে গবেষকেরা এই বনলতা সেনকে খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য। বাস্তবে এমন কোনো বনলতা সেনের অস্তিত্ব কেউ বের করতে পারেননি।
আকবর আলি খান তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইতে ‘লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’ শিরোনামের প্রবন্ধে বনলতা সেনকে বিনোদবালা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রশাসকদের দলিল-দস্তাবেজ থেকে দেখা যায়, নাটোর ছিল উত্তরবঙ্গের রূপোপজীবীদের সব চেয়ে বড় কেন্দ্র। আমার মনে হয়, ‘নাটোর’ শব্দটির দ্বারা তার পেশা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে দেখলে ‘বনলতা সেন’ নামটির তাৎপর্য সহজে বোঝা যায়। সেন পদবি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সে ভদ্রবংশজাত। ‘বনলতা’ বাংলাদেশের ব্যবহৃত কোনো সাধারণ নাম নয়। তাঁর স্খলনের পর নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য হয়তো ছদ্মনাম নিয়েছে।’ আকবর আলি খানের এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আবুতাহের মজুমদার তাঁর ‘জীবনানন্দ’ নামক গ্রন্থে ‘বনলতা সেন’ নামের এক নিবন্ধে বনলতা সেন সম্পর্কিত আকবর আলি খানের গবেষণা কাজকে বিরক্তিকর, স্থূল, দূরান্বয়ী এবং নান্দনিক ধ্যানধারণা-বিযুক্ত বলে মতামত দেন। আবু তাহের মজুমদার তাঁর বক্তব্যেও সপক্ষে অনেকগুলো পয়েন্ট তুলে ধরে বিশ্লেষণ করেন।
আবুতাহের মজুমদারের ব্যাখ্যা হল, বনলতা সেন আসলে বরিশালের ভদ্রঘরের মেয়ে। সেই বর্ণনা জীবনানন্দের ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে রয়েছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের পাশের বাড়ির একজন নারী। আবু তাহের মজুমদারের এ লেখার পর আকবর আলি খান আবার কলম ধরেন। এবার ছোটখাট নয়, বিশদভাবে, আগের চেয়ে শাণিত কলমে তিনি তাঁর লেখা ‘অন্ধকারের উৎস হতে’ বইতে ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো : নতুন আলোকে বনলতা সেন’-এর মাধ্যমে আবু তাহের মজুমদারের যুক্তিগুলো যে ভুল, তিনিই যে সঠিক সেটি পুনরায় পুরনো সেই অনুমাননির্ভর যুক্তি এবং নতুন আরও কিছু যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন। পূর্বের বক্তব্য সেই একই, অর্থাৎ, বনলতা সেন একজন বারবনিতা এবং দুদণ্ড শান্তির খোঁজে জীবনানন্দ তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। নতুন অনুধাবনগুলো আরও বিভ্রান্তিকর। এবার তিনি বনলতা সেন কবিতার তাৎপর্যভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন।
প্রাবন্ধিক অশোক মিত্র ‘বনলতা সেন’ কবিতার পঁচাত্তর বছরপূর্তিতে লিখেছেন, ‘এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এল; সেই সঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনও জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে-মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে-সমস্ত খবর বেরোত।
হয়তো ১৯৩২ সাল হবে। নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নামে এক রাজবন্দি রাজশাহী জেলে আছেনÑ খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল। রাজশাহী থেকে নাটোর তো একচিলতে পথ। ইতিবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপক হয়েছিলেন। কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তরপর্বে অন্য পদবি ব্যবহার করতেন, তাঁর সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কিনা।
কিছু-কিছু রহস্য অন্ধকারে ঢেকে থাক। কবি বনলতার মাঝে সর্বৈব সুখ খুঁজতে গিয়ে কি শূন্যতা, ক্লান্তি নিয়ে ফিরেছেন? পাঠক-সমালোচক আজীবন খুঁজবেন বনলতার সৃষ্টির রহস্য। ‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দ দাশ-এর এই শ্রেষ্ঠ কাব্যটির জন্য জীবদ্দশায় একটি পুরস্কারও পেয়েছিলেন।