হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ রাব্বুল ইয্যত’র অনন্ত হাম্দ ও সানা দিয়ে শুরু করছি, যিনি আমাদের আত্মার শুচিতা ও নির্মলতার জন্য রোযা ফরয করেছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য ‘ত্বাহারত’ বা পবিত্রতার শর্তারোপ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতায় অবনমিত হই, যিনি আমাদের জন্য মাহে রমাদ্বান’র মত এমন এক মাস দিয়েছেন, যা জীবনে একবার পাওয়াও জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য যথেষ্ট।
সর্বান্তকরণে আল্লাহ্ তাআলার একত্বের সাক্ষ্য দেই, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই। প্রকৃত সাহায্যকারী তিনি ছাড়া কেউ নেই। তাঁর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বান্দা পরস্পরকে সাহায্য করে। আমাদের রাহ্নুমা, রাহ্বর শফীয়ে মাহ্শর হযরত সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল, আল্লাহ্র কাছে যাঁর শাফাআত মাকবুল।
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস, পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস, সিয়াম’র মত কৃচ্ছ সাধনায় ব্রতী হওয়ার মাস, হাজার বছরের চেয়েও উত্তম রাত কদরের মাস মাহে রমাদ্বান’র তৃতীয় জুম’আর আজ সাপ্তাহিক সমাবেশ। বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহ্র সব জমায়েত’র ওপর আল্লাহ্ রহম করুন। তাঁর হাবীব, আখেরী নবীর সমগ্র উম্মতে ইজাবত শান্তি ও সুস্থতার সাথে দিনাতিপাত করুন। আমীন।
সিয়াম’র আভিধানিক অর্থ ‘ইমসাকুন নাফস’। অর্থাৎ নফসকে দমন করা। পবিত্র কুরআনের উক্তি, ‘যে নিজ প্রভুর সামনে (জবাবদিহিতার জন্য) দাঁড়ানোকে শঙ্কা করে, আর নফ্সকে কুপ্রবৃত্তি থেকে রুখে, তবে সন্দেহ নেই যে, জান্নাতই হবে তাঁর ঠিকানা। (নাযিআÑত :৪০-৪১) এ কারণে ‘সওম’ বা রোযাকে হাদীস শরীফে ‘জুন্নাতুন’ অর্থাৎ ঢাল বলা হয়েছে। ‘নফস’ যখন ‘আম্মারা’ অবস্থায় থাকে, তখন তা ব্যক্তিকে শুধু মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। এ নফসকে ‘হাওয়া’ বা খেয়াল খুশিমত উদ্ধত আচরণ থেকে প্রতিহত করা যুদ্ধের চেয়েও কঠিনতর। তাই, এ মোকাবেলাকে ‘আশাদ্দুল’ জ্বিহাদ অর্থাৎ কঠিনতর যুদ্ধ বলা হয়। বাস্তবিকই, অদেখা নফস’র মোকাবেলা, দৃশ্যমান শত্রুসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেয়ে দুরূহ বটেই। সিয়াম সাধনার মধ্যে রোযাদার সে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমাদ্বানে সিয়াম’র মত আরেকটি প্রত্যক্ষ সমরাঙ্গণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, ছিনিয়ে আনেন অভূতপূর্ব সাফল্য। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরি ২য় সনের ১৭ রমাদ্বান। মাযহারী, ইবনে কাসীর ইত্যাদি তাফসীর ও সীরাত গ্রন্থের বর্ণনার আলোকে এ যুদ্ধের সার সংক্ষেপ নি¤œরূপ।
মহানবী (দ.) মদীনা মুনওওয়ারায় থেকে জানতে পারলেন, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এক বাণিজ্য কাফেলা প্রচুর পণ্য সম্ভার নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরছে। অধিকাংশ কুরাইশদের তৎকালীন প্রায় পঞ্চাশ হাজার দীনার’র পুঁজি এ বাণিজ্যে বিনিয়োগ হয়। এ বাণিজ্যের উদ্দেশ্য, লব্ধ মুনাফার টাকা দিয়ে মুসলামনদের দফাÑরফা করা। নবীজি ভাবলেন, মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য এ কাফেলাকে ঠেকাতেই হবে।
কিন্তু মুসলমানরা এ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকের আবার বাহনের কিছু নেই। নেই যোগাড় করার সুযোগও। সাহাবাদের ইতস্তত ভাব দেখে নবীজি বললেন, যাঁদের কাছে বাহন আছে, শুধু তাঁরাই রওয়ানা হোক। যাত্রা শুরু হল। ‘বি’রে সুকইয়া’ নামক স্থানে এসে আল্লাহ্র রাসূল তাঁর বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা গোনালেন। তাঁদের সংখ্যা ৩১৩ হওয়ায় তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘তালুত’র সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল। অতএব, শুভ লক্ষণ। উট ছিল মাত্র ৭০টি, তাই পালাক্রমে সওয়ার হলেও অধিকাংশই পায়ে হেঁটে চলছিলেন, স্বয়ং নবীজিও।
এ অভিযানের সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ান এ সংবাদ মক্কার কাফিরদের জানিয়ে দিতে দমদম ইবনে ওমর নামক এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করে। লোকটি আরব রীতিতে উটের নাক কেটে, নিজের জামা সামনে পেছনে ছিঁড়ে, হাওদা উল্টে দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে। এ দৃশ্য দেখে সমগ্র মক্কার যত শত্রু এক সাথে ফুঁসে ওঠে। যুদ্ধের সাজÑসাজ রবে নগরী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দু’শত ঘোড়া, সহ¯্র জোয়ান, ছয়শ’ বর্মধারী সশস্ত্র বাহিনী গায়িকা, নর্তকী বাদ্যবাদকসহ জিঘাংসার স্ফুলিঙ্গ নিয়ে রওনা হল বদর অভিমুখে। প্রতি মনযিলে তাদের জন্য দশটি করে উট জবাই হত।
ওদিকে আবু সুফিয়ানের গতিবিধি জানতে চেয়ে মদীনা থেকে কয়েক মনযিল আসা সাহাবীর কাফেলা জানতে পারেন, তার বাণিজ্য কাফেলা নদীর তীরবর্তী পথে মক্কায় পৌঁছে গেছে। আর তাদের সহ¯্র যোদ্ধার সশস্ত্রবাহিনী ইতোমধ্যে বদর অভিমুখে যাত্রা করেছে। এমতাবস্থায় নবীজির অপ্রস্তুত ছোট্ট এ কাফেলা কাফিরদের রণসম্ভারে সুসজ্জিত বিশালবাহিনীর মোকাবেলা করবে কিনা জানতে চাওয়া হয়। হযরত আবু বকর, হযরত ওমর (রাদ্বি.)সহ শীর্ষস্থানীয় বীর সাহাবীগণ জানালেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দ্বীনসহকারে প্রেরণ করেছেন, আপনি যদি আমাদেরকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমরা তাতেও রাজি। যদি সকালেই শত্রু মোকাবেলার নির্দেশ দেন, আমরা তাতেও প্রস্তুত। আল্লাহ্ চান তো, আমাদের কর্মতৎপরতায় আপনার নয়ন জুড়িয়ে যাবে’। নবীজি এবার মদীনাবাসীর পক্ষে সা’দ বিন মুআযের অভিপ্রায় জানতে চাইলে তিনি আরয করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্ আপনার সাথে থেকে যে কোন পরিস্থিতি বরণে আমাদের কোন দ্বিধা নেই। আমরা বনী ইসরাঈলের ওই লোকদের মত নই, যারা নবী মুসা (আ.) কে বলেছিলেন, ‘আপনি ও আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানেই বসলাম’। তখন মহানবীর চোখ মুখ সন্তুষ্টির আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠল।
যুদ্ধের পূর্ব রাত। শামিয়ানা তলে প্রিয়নবী তাহাজ্জুদ রত। পবিত্র নয়নযুগলে একটু তন্দ্রাভাব। কিন্তু সহসা তিনি হাঁক দিলেন, ‘আবু বকর, সুখবর শুনুন, ওই টিলার পাশে জিব্রীল (আ.) দাঁড়িয়ে, তিনি ‘সাইইহ্যামু জাম্উ ওয়া ইউযাল্লুÑনাদ দুবুর’ (অর্থাৎ অনতিবিলম্বেই ওরা পরাস্ত হবে ও পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে)। পড়তে পড়তে প্রকাশিত হয়েছেন। এরপর নবীজি কয়েকটি স্থান নির্দেশ করে বললেন, ‘এটা আবু জেহেলের মৃত্যুস্থল, ওটা অমুকের। তাঁর উক্তির যেন মৃত্যুর পরোয়ানা। পরবর্তীতে ওরা ওখানেই ধরাশায়ী হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্র অগ্রিম প্রত্যাদেশ ছিল। ‘আর আল্লাহ্ তো বদরের যুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন, অথচ বাহ্যত তোমরা ছিলে দুর্বল’। (৩:১২৩) আল্লাহ্ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ‘বস্তুত তাদেরকে তোমরা কতল করোনি; বরং তাদেরকে কতল করেন আল্লাহ। (৮:১৭) তিনি আরো বলেন, স্মরণ করুন, যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন, ‘আমি তোমাদের সাথে আছি। তোমরা মুমিনদের স্থির রাখো। শীঘ্রই আমি কাফিরদের মনে ভীতির সঞ্চার করছি। অতএব, আঘাত হানো তাদের গ্রীবায়, আর মারো তাদের প্রতিটি অস্থিজোড়ায়’। (সুরা আনফাল : আয়াতÑ১২)
যুদ্ধের ফলাফল : কাফিরদের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। পক্ষান্তরে ১৪ জন সাহাবী শাহাদতবরণ করেন। বিপুল পরিমাণ গণীমতসহ এক অচিন্তনীয় বিজয় সাহাবায়ে রাসূল’র পদচুম্বন করে। আবু জেহেলসহ তাদের অনেক দুর্ধর্ষ সেনানায়ক ও সর্দার নরকগামী হয়। মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা স্বীকৃত হয়। তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও ঈমান আরো জোরদার হয়।
এগিয়ে আসছে মাহে রমাদ্বানের শেষ দশকও। ইতিকফা’র সাধনা এ পর্বে। যে দশকে আছে হাজার রাতের চেয়ে উত্তম কদরের মহান রাত। যে রাতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়। যা সর্বধিক নেয়ামতের আধার। মানবজীবনে ইহÑপরকালের মুক্তি নির্দেশক জীবনব্যবস্থা। সর্বরোগের আরোগ্য। সর্বোপরি তাকওয়াবান বান্দাগণকে আল্লাহ্র নৈকট্যে পৌঁছানোর অব্যর্থ পথনির্দেশনা। কদর’র রাতে বিশেষ রহমতের ফেরেশতার অবতরণ হয় জিব্রীল আমীন (আ.)র নেতৃত্বে। অসংখ্য বান্দা এ রাতে মুক্তির বারতা পাবেন। এ রাতে নেমে আসুক শান্তি, নিরাপত্তা, আরোগ্য, সুস্বাস্থ্য, শুভ কামনার ইপ্সিত নেয়ামত। আমীন।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।