শের, শায়েরী ও শায়ের । পর্ব-৫
কিতনা হ্যায় বদনসীব জাফর দাফন কে লিয়ে
দো গজ জমিন ভি না মিলি কুয়ে য়ার মেঁ
কতটা হতভাগ্য জাফর দাফনের জন্য
দুগজ জমিও পেল না প্রিয়র গলিতে
[ কিতনা-কতটা; বদনসীব- হতভাগ্য;
কুয়ে-রাস্তা বা গলি; য়ার-প্রিয়জন বা বন্ধু ]
কী দুর্ভাগ্য জাফরের, যে জমিন ছিল তার ভালোবাসার সেই জমিনে তার সমাধির জন্য দুই গজ জায়গা হলো না। বন্দী ও নির্বাসিত সম্রাট রেঙ্গুনে হতদরিদ্রের মতো মৃত্যুবরণ করেন। শেষ মুঘল সম্রাটের দাফন হয় তাঁর শেষ আবাসস্থলের পেছনে। ইংরেজদের পরিকল্পনায় সমাধির অবস্থান এমন জায়গায় করা হয়েছিল যাতে লোকজনের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। একশ বছরেরও বেশি সময় তাঁর সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মুঘল সম্রাটদের অনেকেরই সমাধি সুফিগুরু বখতিয়ার কাকির দরবারের পাশে। শেষ মোগল সম্রাটেরও ইচ্ছা ছিল এখানে শায়িত হওয়ার। একটা শূন্য কবরও আছে, যেখানে সমাধি হওয়ার কথা ছিল শেষ মুঘল সম্রাটের। শ্বেত পাথরের কবর বানিয়ে রেখেছিলেন নিজের জন্য। এটাই তাঁর প্রিয় গলির দুই গজ জমিন। শূন্য এই কবরকে ‘সর্দগাহ’ নামে ডাকা হয়। সর্দগাহ মানে যে জায়গা অশ্রুতে সর্বদা ভিজে থাকে।
১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজ শাসনের শতবর্ষকালে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্খায় ভারতবর্ষের দেশপ্রেমিক সিপাহিরা ঐতিহাসিক বিদ্রোহ করেছিল। আওয়াজ উঠলো —
খালক্-ই খুদা, মুলক্-ই বাদশাহ্, হুকুম-ই সিপাহি
সৃষ্টিকুলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, বাদশাহ’র রাজত্ব, সিপাহির কর্তৃত্ব
ভারতবর্ষের প্রথম উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে স্বাধীনতার প্রতীক হলেন বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৫৭ সালের ১১ মে সিপাহিরা ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে দিল্লির লাল কেল্লার ভেতরে দিওয়ানে খাসে সম্মাননা জানায়। তারা ইংরেজদের মাসোহারাভোগী সম্রাটের কাছে নিবেদন করলো তাদের নেতা হওয়ার। বাহাদুর শাহ সিপাহিদের আবেদনে রাজি হয়ে বিদ্রোহকে সারা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দিলেন।
একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা লাল কেল্লা ঘিরে ফেলল। সম্রাটকে কেল্লার এক ছোট্ট ঘরে বন্দী করে রাখা হলো। পরের বছর ২৭ জানুয়ারি থেকে ৯ মার্চ চলা বিচারে সম্রাটকে ইংরেজরা বিদ্্েরাহ, ষড়যন্ত্র আর হত্যার দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করল। যেখানে তিনি কবিসভা আয়োজন করতেন, সেই দিওয়ানে খাসে এক মিলিটারি কমিশন এই বিচার চালিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হলো বাদশাহকে নির্বাসনে পাঠানোর।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ মির্জা জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর দিল্লি নগরী অধিকার করার ৩৩২ বছর পর ১৮৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ভোর চারটায় পালকিসমেত শেষ মুঘল সম্রাটকে গরুর গাড়িতে তোলা হয় এবং তাঁকে তাঁর প্রিয় নগরী থেকে চিরদিনের জন্য নির্বাসিত করা হয়।
বাহাদুর শাহ জাফরকে পরিবারের কয়েকজনসহ প্রথমে পাঠানো হলো এলাহাবাদে। এরপর কোলকাতায়। ১৮৫৮ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপনে ডায়মন্ড হারবার থেকে রেঙ্গুনের পথে যাত্রা শুরু করে মেগোরা নামের একটি যুদ্ধ জাহাজ। সবার অজান্তে ১০ ডিসেম্বর রেঙ্গুনে নামেন রাজপরিবার। ঠাঁই হলো শেদাগন প্যাগোডার পূর্বপাশে সেনাব্যারেকের ভেতরে বার্মিজ আদলে নির্মিত একটি কাঠের বাড়িতে। সম্রাটকবি যাতে কিছু লিখতে না পারেন, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর ছিল ইংরেজদের। সন্ধ্যায় জ্বালানো প্রদীপের সলতের তলায় জমে ওঠা কালি দিয়ে সম্রাটকবি কবিতা লিখতেন দেয়ালে।
যখন ভারতবর্ষের সম্রাট হলেন মির্জা আবু জাফর সিরাজুদ্দিন মুহাম¥দ, তখন তাঁর নামের সাথে যুক্ত হলো বাহাদুর শাহ। ১৮৩৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে নামে মাত্র বাদশাহীর দায়িত্ব নেন তিনি। সম্রাটের খরচ চলতো ইংরেজদের বেঁধে দেওয়া মাসোহারায়।
আকবর-আওরাঙ্গজেবের দৌর্দণ্ড প্রতাপ সর্বশেষ মোগল প্রতিনিধির ছিলো না। বাহদুর শাহ জাফরের আয় বলতে ছিলো ইংরেজ সরকারের এক লাখ রুপি মাসিক পেনশন আর কয়েকটি পরগণা, বাজারের দোকান ভাড়া, জমি ও বাগান থেকে পেতেন আরও সামান্য কিছু। সব মিলিয়ে সোয়া লাখ রুপির মতো।
বাহাদুর শাহ জাফর মুঘল বংশের শেষ শাসক। চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, সহনশীল ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফর সুফিবাদের গভীর অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক। তিনি একাধারে ছিলেন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার, মুঘল চিত্রকলা বা মিনিয়েচারের পৃষ্ঠপোষক, উদ্যান নির্মাণে অসামান্য উদ্যোক্তা এবং সৌখিন স্থপতি।
কবি জাফর নিজে ব্রজ ভাষা, ফারসি আর উর্দুর কবি ছিলেন। তিনি সরল, মধুর আর মনছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় নিপুণতার সাথে সাধারণ মানুষের কথা তুলে আনেন কবিতায়। বাহাদুর শাহ জাফরের প্রকাশিত উর্দু কাব্যগ্রন্থ বা দিওয়ান চারটি। তাঁর তাখাল্লুস বা কবি নাম — জাফর। সাহিত্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রেনেসাঁ হয় তাঁর সময়ে। বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন উর্দু সাহিত্যের দুজন বিখ্যাত কবি মির্জা গালিব ও ইব্রাহিম যওক।
চারটি বিষয় জাফরের দরবারে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলো। প্রথমত সঙ্গীত, দ্বিতীয়ত হস্তলিপি বা ক্যালিওগ্রাফি, তৃতীয়ত মোগল মিনিয়েচার চিত্রকলা ও হাতির দাঁতের কারুকাজ এবং চতুর্থত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় যে বিষয়টি তা হচ্ছে কাব্যচর্চা। তিনি তাঁকে ঘিরে দিল্লির কৃতী ও মেধাবী লোকদের একটি মহল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নিবেদিতপ্রাণ সুফিভাবনার মানুষ ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। পীর মাশায়েখের প্রতি দারুন শ্রদ্ধাবান ছিলেন। নিজে নিয়মিত যেতেন কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির মাজারে। চিশতিয়া তরিকার অনুসারি এই কবিকে অনেকে পীর মানতেন।
বাহাদুর শাহ জাফর ২৪ অক্টোবর ১৭৭৫ সালে দিল্লির লাল কেল্লায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ (১৮০৬-১৮৩৭) ও মা লাল বাঈ। ৭ নভেম্বর ১৮৬২ সালে বার্মার রেঙ্গুনে আজকের মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে চার বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ভাগ্যবিড়ম্বিত সম্রাট দেহত্যাগ করেন। তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি ছিল শুক্রবার, সময়টা ভোর পাঁচটা। অনেক বার্মিজ মুসলমান জানাজায় যোগ দিতে জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ সরকারের সৈন্যরা লোকজনকে জানাজায় শরীক হতে দেয়নি। শুধুমাত্র দুই পুত্র জওয়ান বখত ও শাহ আব্বাস ও তাঁর ভৃত্য জানাজায় লাশের পাশে ছিলেন। একজন মৌলবি জানাজা পড়ান। বিকেল চারটার দিকে আসর ও মাগরিবের মাঝামাঝি সময়ে সম্রাট বাহদুর শাহ জাফরকে দাফন করা হয়।
প্রাথমিকভাবে কবরের জায়গাটা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই সেই বাঁশের বেড়া ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। কবরের ওপরে জন্মায় ঘাসের পুরু আস্তরণ। ক্রমশ হারিয়ে যায় শেষ মুঘল সম্রাটের কবরটি।
১৯০৫ সালে রেঙ্গুনের স্থানীয় মুসলিমরা সমাধির সসম্মান পুনরুদ্ধার চেয়ে বিক্ষোভ করেন। পত্রিকায় লেখালেখি চলতে থাকে। অব্যাহত দাবির মুখে ১৯০৭ সালে ব্রিটিশরা সমাধির কাছে একটা পাথরের ফলক বসায়। বহুবছর পর ১৯৯১ সালে শেদাগন প্যাগোডার কাছে ওই জায়গায় শ্রমিকেরা ড্্েরন বানানোর জন্য মাটি খুঁড়ছিলেন। আকস্মাৎ বেরিয়ে পড়ে পোড়া ইটের দেয়াল দেওয়া এক কবর। ওপরে কিছু লেখা। সেই লেখা পড়ে জানা যায় এটা কার সমাধি। এবার গড়ে ওঠে সম্রাট দরবেশের দরগাহ। ১৯৯৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেই তীর্থস্থান দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বাহাদুর শাহ জাফরের নির্বাচিত কিছু শের-
না দরবেশোঁ কা র্খিকা চাহিয়ে না তাজ-এ-শাহানা
মুঝে তো হোশ দে ইতনা রহূঁ ম্যাঁয় তুঝ পে দিওয়ানা
না চাই দরবেশের লেবাস না চাই বাদশাহী তাজ
আমাকে হুঁশ দাও এটুকু, থাকি তোমাতে দেওয়ানা
[ দরবেশোঁ কা র্খিকা-দরবেশের লেবাস;
তাজ-এ-শাহানা -বাদশাহী তাজ;
হোশ-হুঁশ; ইতনা-এটুকু; রহূঁ-থাকি;
দিওয়ানা-দেওয়ানা (প্রেমে পাগল) ]
মুহাব্বত চাহিয়ে বাহাম হামেঁ ভি হো তুমহে ভি হো
খুশি হো ইস মেঁ য়া হো গম হামেঁ ভি হো তুমহে ভি হো
ভালোবাসা চাই পরস্পর, হোক আমারও তোমারও
খুশি বা দুঃখ যাই থাক, হোক আমারও তোমারও
[ মুহাব্বত-ভালোবাসা; বাহাম -পরস্পর;
গম-দুঃখ ]
না কুছ হাম হাসঁ কে সিখে না কুছ হাম রো কে সিখে
যো কুছ তোড়া সা সিখে হ্যায়ঁ তুমহারে হো কে সিখে হ্যায়ঁ
না কিছু আমি শিখেছি হাসি থেকে না কান্না থেকে
যা কিছু সামান্য শিখেছি তোমার হয়েই শিখেছি
[ হাম-আমি; হাসঁ-হাসি; সিখে-শিখেছি; রো-কান্না;
তোড়া-সামান্য; তুমহারে-তোমার ]
কিসিকো হামনে য়াঁ আপনা না পায়া
জিসে পায়া উসে বেগানা পায়া
এখানে কাউকে আমি আপন পেলাম না
যাকে পাই, সেই দেখি পর
[ কিসিকো- কাউকে; হামনে-আমি; য়াঁ-এখানে;
জিসে-যাকে; বেগানা-পর ]
দ্যায়র ও কাবা মে ঢুন্ডতা হ্যায় কেয়া
দেখো দিল মেঁ কি বস য়েহি কুছ হ্যায়
মন্দির আর কাবায় কী খোঁজো
হৃদয়ে দেখ, সামান্য যা কিছু এখানেই আছে
[ দ্যায়র-মন্দির; ঢুন্ডতা- খোঁজা বা সন্ধান করা;
দিল-হৃদয়; য়েহি-এখানে ]
করো ইশকবাযি জাফর তুম সামঝকর
য়ে হ্যায় কাম মুশকিল না আসান সামঝো
প্রেমের খেলা খেলো জাফর বুঝে শুনে
এ বড় কঠিন কাজ, সহজ ভেবো না
[ ইশকবাযি-প্রেমের খেলা; সামঝকর- বুঝে শুনে;
মুশকিল-কঠিন; আসান-সহজ; সামঝো-ভাবা ]
জাফর ইস মেঁ সামঝকর পাওঁ রাখনা
মুহাব্বত ইক ব্যাহরে বেকারাঁ হ্যায়
জাফর, এখানে সাবধানে রেখো পা
প্রেম, সে তো এক অস্থির সমুদ্র
[ সামঝকর- বুঝে শুনে বা সাবধানে;
ব্যাহরে-সমুদ্র; বেকারাঁ-অস্থির ]
উমরে দারায মাংগ কে লায়া থে চার দিন
দো আরযু মেঁ কাট গ্যায়ে দো ইন্তেযার মেঁ
দীর্ঘ আয়ু চেয়ে পেয়েছি মাত্র চার দিন
দু’দিন কাটলো আশায় দু’দিন অপেক্ষায়
[ উমরে দরাজ-দীর্ঘ আয়ু; মাংগ-চাওয়া;
আরজু-আশায়; ইন্তেযার-অপেক্ষায় ]
চয়ন ও উপস্থাপন • রুশো মাহমুদ

















































