মোহাম্মদ শাহজাহান »
সমবায় সমিতির ইতিহাস প্রায় মানবসভ্যতার ইতিহাসের ন্যায় প্রাচীন। বর্তমানের সমবায় সমিতির সাংগঠনিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের কিছু পূর্বেই। ব্রিটিশ ভারতের জেনারেল লর্ড কার্জন সর্বপ্রথম ১৯০৪ সালে সমবায় সমিতি আইন জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমেই এই উপমহাদেশে সমবায় আন্দোলনের অভিযাত্রা শুরু হয়।
“দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ” কিংবা “দশের লাঠি একের বোঝা” প্রভৃতি বহুলপ্রচলিত প্রবাদ বাক্যগুলো সমবায় আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, আর তা হলো সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন। বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের একটি সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ-পরিক্রমা রয়েছে। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এবার সমবায় দিবসের শ্লোগান “বঙ্গবন্ধুর দর্শন-সমবায়ে উন্নয়ন”।
বাঙালি জাতির হাজার বৎসরের শ্রেষ্ঠ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নেতৃত্বের মোহিনী শক্তি দিয়ে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তার ফসল হিসাবে ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র মহান নেতা যিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে একটি জায়গায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর পেরেছিলেন স্বাধিকার বঞ্চিত হতভাগ্য বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে এবং তাঁর মহান নেতৃত্বে জাতি স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এদেশের মানুষ স্বাবলম্বী হবে এবং বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তাই তিনি বহির্বিশ্বের সাহায্য গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন এবং সকল সমস্যা সাময়িকভাবে দূর করার পথ পরিহার করে স্থায়ী পথ হিসাবে সমবায়কে বেছে নিয়েছিলেন। তাই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে সমবায়ের ডাক দিয়েছিলেন।
পরিবেশ ও প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় সম্পদ। যেহেতু বঙ্গবন্ধু এদেশের মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন, তাই এই সম্পদ যথার্থ কাজে লাগাতে এবং দেশ গঠনের নিয়ামক হিসাবে এক পর্যায়ে গ্রহণ করলেন সমবায় ভিত্তিক কর্মযজ্ঞ। দেশকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ, সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুযোগ সুবিধা দান নিশ্চিত করার গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে দেশের উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালীসমূহের মালিকানার ক্ষেত্রে সমবায়ী মালিকানাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মালিকানা খাত হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
তিনি ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার আহবান জানিয়ে বলেছিলেন ‘আগামী পাঁচ বৎসরে সরকার বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্নমুখী সমবায় চালু করবে’। এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সমবায়ের মাধ্যমে দেশের সম্পদ সুষমভাবে ব্যবহারের জন্য জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলা যায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে একটি রাজনৈতিক ফ্্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করা এবং দেশের আর্থ সামাজিক ও রাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন আনয়ন পূর্বক সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করা। এই প্রসঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, গ্রামে গ্রামে বহুমুখি কো-অপারেটিভ করা হবে এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ করার বিষয়টি সন্নিবেশিত হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যে মহান ব্যক্তি হতভাগ্য বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর থেকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আজীবন কঠিন সংগ্রাম করে গেছেন সে মহান পুরুষকে তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রস্তুতিতেই কিছু সংখ্যক কুচক্রী ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে।
কিন্তু বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও বাঙালি জাতির স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বর্তমানে সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় চলমান বিশে^র অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যোগ্য উত্তরসূরী, বাংলার শান্তিকামী মানুষের আশ্রয়স্থল, বর্তমান বিশে^ মানবিক মূল্যবোধের লালন ও পালনকারী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নত ও আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ^াস করি।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে বহু প্রতিষ্ঠান তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফলতা পেয়েছে। যার মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠি বিপুলভাবে উপকৃত হয়েছে, এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি.। এই সমবায়ী প্রতিষ্ঠানকে ৬৯ বৎসরের অগ্রযাত্রায় সফল কর্মকা-ের জন্য ২০১৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতীয় সমবায় পুরস্কারে ভূষিত করেন। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা ও উন্নয়ন দর্শন একান্তই প্রাসঙ্গিক। তাই বলতে হয় আমাদের যা কিছু অর্জন, যতসব উন্নয়ন তার ভিত্তিমূলে রয়েছে জাতির জনকের আজীবন স্বপ্নলালিত উন্নয়ন ভাবনা- জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের স্বপ্ন। দেশকে স্বাবলম্বী করতে হলে সমবায়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এ দর্শন বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনাকে পাথেয় করে আমাদের মানসিকতার ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে আসুন, আমরা সকলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গড়ে তুলি আমাদের কাক্সিক্ষত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। ৪৯তম জাতীয় সমবায় দিবসের শ্লোগান “বঙ্গবন্ধুর দর্শন-সমবায়ে উন্নয়ন” বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস।
লেখক : সম্পাদক, দি চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি.