ড. মো. মোরশেদুল আলম »
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রবল আকার ধারণ করে যা উভয়ের মধ্যে প্রাক্-ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধের কারণে উভয় সম্প্রদায় ক্রমশ একে অপরের নিকট থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের সাথে সাথে এ দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন যা পরবর্তী সময়ে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবেÑপাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। ওখানেও হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও’। লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চল নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও মুসলিম লীগ গঠনতন্ত্র বিরোধী উপায়ে ১৯৪৬ সালের ৬ এপ্রিল ‘ংঃধঃবং’ শব্দটি সংশোধন করে ‘ংঃধঃব’ বা একটি রাষ্ট্রগঠনের কথা উল্লেখ করে।
বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগ ও জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চেয়েছিল। কারণ, মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর-নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। ওই শ্রেণির বাইরের কাউকে লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে পুরে রেখেছিল। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘‘দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান-চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।…ইংরেজদের কথা হল, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।”
১৯৪০-৪৬ সাল পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল সংঘাতময় ঘটনাপ্রবাহে বিজড়িত। ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে যে, মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনড়। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে লেখেন, ১৯৪৫ সালের গোড়ার থেকেই ইলেকশনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইলেকশন হবে, সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী মুসলমানরা ‘পাকিস্তান’ চায় কি চায় না তা নির্ধারণ করতে। কারণ, কংগ্রেস দাবি করে যে, তারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। নজির হিসেবে তারা বলেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি। একথা সত্য যে, কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলমান নেতা তখন পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানের উপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। তাছাড়া কতগুলি প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগুরু আছে। আর যদি পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান দুইটা রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দুস্তানে যে সমস্ত মুসলমানরা থাকবে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। অন্যদিকে মুসলিম লীগের বক্তব্য পরিষ্কার, পাকিস্তানের হিন্দুরাও সমান নাগরিক অধিকার পাবে। আর হিন্দুস্তানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে। লাহোর প্রস্তাবে একথা পরিষ্কার করে লেখা আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরকে ত্বরান্বিত করতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতসচিব লর্ড পেথিক লরেন্সের নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদলকে ভারতে পাঠায়। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে মিস্টার চার্চিল ভারতে ক্রিপস মিশন পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। যুদ্ধের পর যখন মিস্টার ক্লিমেন্ট এটলি লেবার পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ মার্চ তারিখে ক্যাবিনেট মিশন পাঠাবার কথা ঘোষণা করলেন; তাতে তিনজন মন্ত্রী থাকবেন, তাঁরা ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সাথে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যাতে তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবেÑবড়লাটের সাথে পরামর্শ করে।…মিস্টার এটলির বক্তৃতায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির কথা উল্লেখ তো নাই-ই বরং সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি কটাক্ষ করেছিলেন।”
এমতাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ সালে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা মেনে নেয়। কিন্তু সেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি প্রত্যাহৃত হয়। কংগ্রেস কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেসের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রত্যাহার এবং অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনে ভাইসরয়ের কংগ্রেস নীতির জন্য ১৯৪৬ সালের লীগ কাউন্সিলের বোম্বে অধিবেশনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবির পুনরাবৃত্তি করে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন। সাম্প্রদায়িক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের বড়লাট নিযুক্ত করে। তিনিই ছিলেন অবিভক্ত ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘১৯৪৬ সালের শেষের দিকে ভারতের রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার বদ্ধপরিকর যে কোনোমতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস প্রথমে গ্রহণ করে পরে পিছিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বড়লাট লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করলেন। লর্ড ওয়েভেল মুসলিম লীগের সাথে ভালো ব্যবহার না করায় মুসলিম লীগ অন্তর্বতীকালীন সরকারে যোগদান করতে অস্বীকার করে। কংগ্রেস প-িত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে সরকারে যোগদান করে। যদিও লর্ড ওয়েভেল ঘোষণা করেছিলেন, মুসলিম লীগের জন্য পাঁচটা মন্ত্রিত্বের পদ খালি রইল, ইচ্ছা করলে তারা যে কোন মুহূর্তে যোগদান করতে পারে। সরকারে যোগদান না করে একটু অসুবিধায় পড়েছিল মুসলিম লীগ। শেষ পর্যন্ত জনাব সোহরাওয়ার্দী লর্ড ওয়েভেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলিম লীগ যাতে অন্তর্বতীকালীন সরকারে যোগদান করতে পারে সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেন। মি. জিন্নাহ তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন আলোচনা চালাতে। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ-ওয়েভেল আলোচনা করে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে রাজি হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রিগড়, আবদুর রব নিশতার, রাজা গজন্ফর আলী খান এবং যোগেন্দ্রনাথ ম-ল মুসলিম লীগের তরফ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারে যোগদান করেন। মুসলিম লগি যদি কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান না করত তবে কংগ্রেস কিছুতেই পাকিস্তান দাবি মানতে চাইত না।’’
পাকিস্তান অর্জনের লক্ষ্যে মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়। সংগ্রামের কর্মসূচিকে হিন্দু নেতৃবর্গ ভুল ব্যাখ্যা দেন। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ২৯ জুলাই জিন্নাহ সাহেব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা বোম্বে শহরে আহ্বান করলেন।…জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন। তিনি বিবৃতির মারফত ঘোষণা করেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে এই দিবস পালন করতে। ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি এটা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধপরিকর। কোনো রকম বাধাই তারা মানবে না। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’, তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।”ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। যা ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দেয়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়!…লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা, আর নিচে পুরুষরা।…মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে।’ কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই আবার নোয়াখালীতে দাঙ্গা শুরু হয়। মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই ছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা। এতে অনেক লোক মারা যায়, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসেন। তাঁর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মতানৈক্যের ফলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত তখন অকেজো। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তখন মারাত্মক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চলছিল। ফলে তখন এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের অখ-তা আর কোন ক্রমেই রক্ষা করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট দূর করে ভারতীয় জনগণের নিজস্ব ইচ্ছা অনুসারে ভারত বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের নিকট এক পরিকল্পনা পেশ করেন, যা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা অনুসারে ভারত বিভাগ ও শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস হয়। ১৯৪৭ সাালের আগস্ট মাসে চূড়ান্তভাবে অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়