হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলাই সব প্রশংসার সর্বৈব মালিক, যিনি আমাদেরকে দিয়েছেন কথা বলার শক্তি। তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যিনি হালালের অর্থে পবিত্র শব্দ প্রয়োগ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি নিজ বান্দাদেরকে কৃতজ্ঞতার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ্ এক। তাঁর কোন শরীক নেই, নেই কোন সমকক্ষ। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, দ্বিতীয় কারো সে ক্ষমতা বা যোগ্যতা নেই। তিনি ¯্রষ্টা, বাকি সব সৃষ্টি। তিনিই শুধু উপাস্য, বাকি সব উপাসক। তিনি রিযিকদাতা, সবকিছু সেই রিযকের মুখাপেক্ষী। আমাদের কাছে তাঁর পরিচয়দাতা, বন্দেগীর স্বরূপ ব্যাখ্যাতা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর সেরা রাসূল। যাঁর ওপর অর্পিত পবিত্র কুরআন, যাঁর মুখ-নিঃসৃত বাণী সে কুরআনেরই সন্দেহাতীত ব্যাখ্যা।
মহান রাব্বুল আলামীন যে দ্বীন আমাদের জন্য একমাত্র ‘দ্বীন’ হিসাবে মনোনীত করেছেন, তার নাম ইসলাম। ইসলামের রুকন বা ভিত্তি পাঁচটি। যথা-কালেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত। আমরা সবাই কমবেশি এগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা শৈশব থেকে অর্জন করে থাকি। যে সব বিষয় পালন করা, আদায় করা আমাদের ওপর ফরয, সেগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে জেনে রাখাও ফরয। তাই এটুকু ইলম অর্জন করাও হাদীস শরীফে ফরয বলা হয়েছে।
কালেমা বলতে যদিও কিছু শব্দমালা বুঝায়, ব্যবহারিক জীবনে এগুলো শব্দের ঘেরে ফেলে রাখা কিন্তু সঙ্গত নয়। শব্দমালার অর্থাবলী অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস এবং মুখেও অকপটে স্বীকার করা অবশ্যই জরুরি। সেটা কিন্তু ঈমান। ঈমানের সংজ্ঞা হলো, আল্লাহ্র নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতদসংক্রান্ত মৌলিক যা নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন, তা সবই অকাট্য সত্য বলে অন্তরে বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করা। তাতে বাকি চার মৌলিক নির্দেশ, যথা-নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত প্রভৃতিও স্বীকৃত হয়। ঈমান প্রতি নিয়ত আজীবন লালন করতে হয়। নামায দৈনিক পাঁচবার পালনীয়। রোযা বছরে একমাস। যাকাত বছরে একবার প্রদেয়। আর হজ্ব সারা জীবনে একবার পালন করা ফরয। নামায ও রোযা দৈহিক ইবাদত। যাকাত শুধুই আর্থিক। আর হজ্ব হলো দৈহিক ও আর্থিক ইবাদতের সমন্বিত প্রয়াস।
হজ্ব অবশ্যই ব্যয়বহুল ও শ্রমসাপেক্ষ ইবাদত। এ কারণেই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের ওপর আল্লাহ্র জন্য বাইতুল্লাহ্র হজ্ব করা ফরয, যে সেখান পর্যন্ত পথ অতিক্রমের সামর্থ রাখে।’ (৩:৯৭) আবার দূর-দূরান্তের মুসলামনদের জন্য এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, সে সময়টিতে পরিবার হতে হজ্ব পালনকারীর অনুপস্থিতিও শরীয়ত বিবেচনা করেছে। এ কারণে ‘সামর্থ’ কথাটি একটু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। হাদীস শরীফে হুযূর, সায়্যিদে আলম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এখানে ‘যান্দ ও রাহেলা’ শব্দযোগে এ ব্যাখ্যার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যার অর্থ আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়ার ব্যয়-সামর্থ। উপরন্তু, যাওয়া থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবার ও পোষ্যদের ভরনপোষণের ব্যয়ভারও মওজুদ থাকা চাই। তদুপরি পথের নিরাপত্তাও থাকা চাই। নিজেও দৈহিক সুস্থ-সবল থাকা শর্তাধীন। মহিলাদের জন্য বাড়তি শর্ত হলো স্বামী বা মহরম পুরুষ (অর্থাৎ যার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম) সফরসঙ্গী থাকতে হবে। তার খরচ সে নিজেই বহন করুক, কিংবা মহিলা করুক। নচেৎ, তার সামর্থ পূর্ণ হয়নি বলে বিবেচিত। এমন সফরসঙ্গী ছাড়া সফর করাও মা- বোনদের জন্য না-জায়েয, অর্থাৎ হারাম। (তাফ. মাআরেফুল কোরআন)
হজ্বের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি আল্লাহ্র ঘর সংশ্লিষ্ট। পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ‘হিজ্জুুল বাইত’ শব্দটি তা ইঙ্গিত করছে। তাই, হাজী ভাইবোনদের সফর’র গন্তব্যস্থল প্রধানত বাইতুল্লাহ্ শরীফ। খানায়ে কা’বা বাইতুল্লাহ শরীফের প্রাচীনত্বের কথা সুরে আÑলে ইমরান’র ৯৭তম আয়াতে বর্ণিত। পৃথিবীতে নির্মিত এটাই সর্বপ্রথম গৃহ। খানায়ে কা’বাকে বিশ্বসভ্যতা, মানবসভ্যতার জন্য বুনিয়াদ বা ভিত্তিও বলা হয়েছে। (সূত্র: সুরা মায়েদাÑ৯৭)
আল্লাহ্র ঘর সংক্রান্ত বর্ণনা সম্বলিত সুরা আলে ইমরান’র ৯৭তম আয়াতের তাফসীরে এর কাঠামোগত বিবর্তনের অনুপুঙ্খ বিবরণ একাধিক তাফসীরকার নিজ নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। এর সারবত্তা আগ্রহী পাঠক সমীপে বিবৃত হল। পৃথিবীতে আগমনের পর আদমÑহাওয়া (আ.) জিবরাঈল (আ.) মারফত কা’বা ঘর নির্মাণের জন্য আল্লাহ্র নির্দেশ পান। যথা নির্দেশ তাঁরা কা’বা গৃহ নির্মাণ করেন। এরপর তাঁরা এ ঘরের তাওয়াফ করার জন্য নির্দেশ পান। উভয়ে তাও পালন করেন। তখন বলা হলো, পৃথিবীতে আগমনকারী আপনি প্রথম মানব আর এটাই সর্বপ্রথম গৃহ, যা মানবম-লীর জন্য নির্মিত হলো। (বায়হাকী সূত্রে ইবনে কাসীর)
আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কা’বা ঘর নূহ (আ.)র মহাপ্লাবন পর্যন্ত অক্ষত ছিল। মহাপ্লাবনে এটাও ধসে যায়। বহুকাল পরে হযরত ইবরাহীম (আ.) প্রাচীন ভিত্তির ওপর এটার পূনঃ নির্মাণের নির্দেশ পান। তিনি প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) সহ তা পুনর্নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এটার প্রাচীর ধসে পড়ে। জুরহাম গোত্রের লোকেরা তা সংস্কার করেন। এভাবে একাধিকবার তা ধসে যাওয়ার পর আমালেকা সম্প্রদায়, পরবর্তীকালে কুরাইশ গোত্র এর সংস্কার করে। এ নির্মাণকালে স্বয়ং মহানবী (দ.) ও অংশগ্রহণ করেন। শুধু অংশগ্রহণই নয়; বরং চার গোত্রের সর্বসম্মতিক্রমে তিনিই হাজরে আসওয়াদ শরীফ যথাস্থানে পুণঃ স্থাপন করেন। এভাবে নিজেদেরও অজান্তে তারা তাঁকে শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত মেনে নেয়।
কুরাইশদের নির্মাণে হযরত ইবরাহীশ (আ.)র নির্মাণ কাঠামোতে পরিবর্তন করা হয়। কা’বা ঘরের উত্তর পাশের দেয়াল একটু ভেতরে দিয়ে কিছু অংশ বাইরে রাখা হয়। তবে অর্ধবৃত্তাকারে তিন ফুটের মত পুরো দেয়াল রাখা হয়, যাতে তাওয়াফের সময় কা’বার পুরো অংশ বেষ্টনীর মাঝেই থাকে। কেউ এর ভেতর দিয়ে গেলে তাওয়াফ হবে না। এ অংশটার নাম ‘হাত্বীম’। আরবী এ শব্দের অর্থ ভেঙে রাখা অংশ, ভগ্নাংশ। ২য়তঃ প্রবেশ ও বেরিয়ে আসার জন্য আলাদাভাবে বিপরীতমুখি দুটি দরজা ছিল। কুরাইশরা পশ্চিমে বের হওয়ার দরজাটা বন্ধ করে দেয়, প্রবেশের জন্য পূর্বদিকের দরজাটাই বাকি রাখে। ৩য়তঃ দরজাটি আগে সমতলে ছিল, তারা এটা অনেক উঁচু করে দেয়, যাতে তাদের অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
একবার আল্লাহ্র রাসূল মুমিন জননী আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বি.) কে জানান, ‘আমার ইচ্ছে হয়, কা’বা গৃহের বর্তমান কাঠামোকে আবার ইবরাহীম (আ.) র নকশাÑঅনুরূপ করে দেই। কিন্তু অজ্ঞ নও মুসলিমদের ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হবে। এ আশঙ্কায় আমি তা করছি না।’ তার কিছুদিন পরই তিনি লোকান্তরিত হন। হযরত আয়েশা (রাদ্বি.)র মাধ্যমে তাঁর ভগ্নিপুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে যোবাইর (রাদ্বি.) রাসূলুল্লাহ্ (দ.)র সে অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত হন। পরবর্তীতে মক্কা শরীফের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তিনি রাসূলুল্লাহ্র সে ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন।
এ অবস্থা বেশিদিন যেতে পারেনি, অত্যাচারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে যোবাইর (রাদ্বি.) কে শহীদ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। আর ব্যাপক প্রচার চালায় যে, আব্দুল্লাহ এ কাজটি অন্যায় করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ যেভাবে কাবা ঘরকে রেখে যান, সে অবস্থায় রাখা উচিত ছিল। এরপর সে কা’বা ঘরের কাঠামো কুরাইশদের কাঠামোতে পুনঃনির্মাণ করে। বস্তুতঃ এটা ইবরাহীম (আ.) নির্মিত নকশা ছিল না; বরং এটা হল জাহেলী যুগের কুরাইশদের নির্মাণ। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পর কোন কোন বাদশাহ্ মুমিন জননী হযরত আয়েশা (রাদ্বি.) বর্ণিত হাদীস অনুসরণে খানায়ে কা’বাকে আবারও আদি নকশায় পুনঃনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তখন সময়ের বিশ্ববরেণ্য ইমাম হযরত মালেক বিন আনাস (রাদ্বি.) উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ মর্মে ফতওয়া জারি করলেন যে, আর নয়, আল্লাহ্র ঘরকে এভাবেই সংরক্ষিত রাখা উচিত। কারণ, এভাবে ভাঙাÑগড়া অব্যাহত রাখলে মুসলিম শাসকদের জন্য আগামী প্রজন্মের কাছে এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। আর কা’বায়ে মুআযযামার সর্বোচ্চ মর্যাদার বিষয়টি তাদের হাতে নিছক খেলনায় পর্যবসিত হবে। আর সারা বিশ্বের অগণিত মুসলিম নরÑনারীর ধর্মীয় অনুভূতিতে তা হবে চরম আঘাত। কাজেই তাতে আর হাত লাগানো নয়, যেভাবে আছে, সে অবস্থাতেই বহাল রাখতে হবে’। সারা বিশ্বের মনীষীরা তা সানন্দে মেনে নিয়েছে। তবে সংস্কার, মেরামত, নকশাÑকারুকাজ, যথারীতি অব্যাহত আছে।
কুরাইশ বা হাজ্জাজের ইস্যু নয়, এটা বরং আল্লাহ্র ঘরের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন। কা’বা ঘর কোন রাজা-বাদশা বা শাসক গোষ্ঠীর নয়, কোন দেশের ভৌগলিক সীমারেখার জন্য নির্দিষ্ট রাষ্ট্রসম্পদও নয়, সারা দুনিয়ায় ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে হৃদয়ে কা’বা, নিজ কিবলার জন্য হৃদপি- নিংড়ে দিতেও তাঁরা কুণ্ঠিত নয়। তাদের কোরাশ, ‘বক্ষে আমার কা’বার ছবি, চক্ষে মুহাম্মদ রাসূল’।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।