সুপ্রভাত ডেস্ক »
কিছু পরাজয় ক্ষত রেখে যায় গভীরে, অনুক্ষণ পোড়াতে থাকে। চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষের সেই হার আর্জেন্টিনার জন্য ঠিক তেমনি। ওই হারের ধাক্কা সামলে কষ্টে-চেষ্টে গ্রুপ পর্ব মেসিরা পার হতে পারেন বটে, কিন্তু গ্রুপ রানার্সআপ হওয়ার সুবাদে শেষ ষোলোয় দেখা ফ্রান্সের সঙ্গে। সেখানেও বিষাদ সঙ্গী। শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায় আর্জেন্টিনার। খবর বিডিনিউজের।
দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে আগামী মঙ্গলবার কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে সেই ক্রোয়েশিয়ার সামনে আর্জেন্টিনা। মেসিদের মনে নিশ্চিতভাবে উঁকি দিচ্ছে নভগোরোদের সেই দুঃসহ স্মৃতি। এবার সেই বকেয়া হিসাব সুদে-আসলে চুকানোর পালা দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
কেবল ওই হার নয়, বিশ্বকাপের পাতায় আসলে আর্জেন্টিনার বকেয়ার পাল্লা বেশ ভারি। সেই ১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনা নামের এক জাদুকরের হাত ধরে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরা, এরপর সময়ের ডানায় চেপে পেরিয়ে গেছে একটি-দুটি নয় ৩৬টি বছর, কালের চোরাস্রোতে হারিয়ে গেছে আটটি আসর, কিন্তু সোনায় মোড়ানো ট্রফিতে আলবিসেলেস্তেদের চুমু আঁকা আর হয়ে ওঠেনি।
সম্ভাবনার প্রদীপ মাঝেমধ্যে জ্বলেছে, কিন্তু ঝরাপাতার মতো মর্মর করুণ সুর তুলে তা হারিয়েও গেছে। সবশেষ সম্ভাবনার উঁকি ২০১৪ সালে, এই মেসিদের হাত ধরেই। কিন্তু ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে মারিও গোটসের একমাত্র গোলে জার্মানির কাছে হেরে স্বপ্ন ভাঙে আর্জেন্টিনার।
২০১৮ সালে মেসি আরও পরিণত। মারাকানার সেই দুঃখ ভুলে আশায় বুক বাঁধে আর্জেন্টিনা। দলটির সমর্থকদের স্বপ্নও আকাশচুম্বি। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের পথচলার শুরুতে আইসল্যান্ড ধাক্কায় নড়ে যায় তা। এরপর ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ আসে দুঃস্বপ্ন হয়ে। মেসি-আগুয়েরোদের খোলসবন্দী করে রেখে দ্বিতীয়ার্ধে একের পর এক গোল উৎসবে মাতে ক্রোয়াটরা। শুরুটা করেন আন্দ্রে রেবিচ, পরে জালের দেখা পান লুকা মদ্রিচ ও ইভান রাকিতিচ। মেসি মলিন, আর্জেন্টিনা অসহায়, সমর্থকরা স্তব্ধ-এই ছিল নভগোরোদে হোর্হে সাম্পাওলির দলের ম্যাচ রিপোর্ট!
ক্রোয়াটদের বিপক্ষে ৩-০ গোলের ভরাডুবিতে পরিসংখ্যানের বেশ কয়েকটি পাতায় নাম উঠে যায় আর্জেন্টিনার। বলার অপেক্ষা রাখে না, তা ছিল ব্যর্থতার ফিরিস্তিতে ভরা। ১৯৭৪ সালের জার্মানি বিশ্বকাপের পর ওই প্রথম কোনো আসরে শুরুর দুই ম্যাচ জিততে পারেনি তারা। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার কাছে ৬-১ গোলের ভরাডুবির পর এটাই ছিল গ্রুপ পর্বে আকাশি নীল-সাদা জার্সিধারীদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের হার। গ্রুপ পর্ব ও নকআউট পর্ব মিলিয়ে ২০১০ সালে কেপ টাউনের জার্মানির কাছে কোয়ার্টার-ফাইনালে ৪-০ ব্যবধানের পরাজয়ের পর ছিল প্রথম তিন বা তার বেশি গোল ব্যবধানের হারও।
এই ক্ষত কিছুটা পুষিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হওয়া আর্জেন্টিনার শেষ ষোলোর প্রতিপক্ষ ছিল ফ্রান্স। শিরোপা জয়ের পথে ফরাসিরা যাত্রাও শুরু করেছিল ৪-৩ গোলে মেসি-মাসচেরানোদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে। আর্জেন্টিনাকে উড়িয়ে উজ্জীবিত ক্রোয়াটদের জয়রথ ছুটেছিল ফাইনাল পর্যন্ত। ফ্রান্সের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল জ্লাতকো দালিচের দল। এবারও সেই ক্ষুরধার মস্তিস্কের কোচ দালিচের মুখোমুখি আর্জেন্টিনা। নভগোরোদের স্মৃতি, প্রতিশোধের দুর্নিবার আকাক্সক্ষা মেসিদের মনে উঁকি না দিয়ে পারেই না!
কিন্তু তা পূরণের পথ বড্ড কঠিন। ক্রোয়াটদের আছে লুকা মদ্রিচ, মাতেও কোভাচিচ, মার্সেলো বোরোভিচের মতো নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার। বলের নিয়ন্ত্রণে, কৌশলগত দিকে এই ত্রয়ী পাকা খেলোয়াড়। মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের আক্রমণের তান কেটে দিতে দারুণ পটু। চার বছর আগের সুখস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করতে মরিয়া থাকবে তারা। দলটির কোচ দালিচও হুঙ্কারের সুরে পাঠিয়েছেন বার্তা-মেসিদের নিয়ে ভীত নয় ক্রোয়েশিয়া।
কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে সাফল্যে আরও উজ্জীবিত তারা। ‘প্রফেসর’ খ্যাত তিতের কৌশলকে ভেস্তে দিয়ে নির্ধারিত নব্বই মিনিট সমতায় শেষ করে তারা। অতিরিক্ত সময়ে নেইমারের গোলে সেলেসাওরা এগিয়ে গেলেও চোখে চোখ রেখে লড়াই করে যাওয়া দালিচের দল সমতায় ফেরে ব্রুনো পেতকোভিচের লক্ষ্যভেদে। তাতে ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় টাইব্রেকারে।
স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ে দমিনিক লিভাকভিচ পাহাড়সমান দৃঢ়তায় আগলেছেন ক্রোয়েশিয়ার পোস্ট। তাতে রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে সেরা চারের মঞ্চে উঠে আসে তারা। যেখানে প্রতিপক্ষ মেসির আর্জেন্টিনা।
বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ মঞ্চে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মুখোমুখি হবে দুই দল। আগের দুই দেখায় ১৯৯৮ সালের আসরে আর্জেন্টিনার জয় ১-০ গোলের। ২০১৮-তে ক্রোয়েশিয়ার জয় ৩-০ ব্যবধানের। এবারই প্রথম দেখা হচ্ছে নকআউট পর্বে। কারো সামনে বিকল্প পথ খোলা নেই। ক্রোয়েশিয়ার চার বছর আগের প্রাপ্তি, আর্জেন্টিনার ব্যর্থতা ছড়াচ্ছে বাড়তি উত্তেজনার রেণু।