বকবন্ধু

কাজী নাজরিন »

বিকেল বেলা হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে ঘরের সামনের উঠোনে অনেক লতাপাতা এবং ডালপালা পড়ে পুরো উঠোন ময়লা হয়ে গেছে। আম্মা সন্ধ্যার আগে আগে সেগুলো আবার পরিস্কারের কাজে নেমে পড়েছেন।
হঠাৎ আম্মা, ভাইয়াকে ঢেকে বললেন এদিকে আয় জাভেদ, দেখ এটা কী?
ভাইয়া হাতে নিয়েই সেই রকমের একটা হাসি দিয়ে বলল, ওহে ওহে এটা আমার বন্ধু বোগি বোগি।
ধবধবে সাদা বকের বাচ্চা একদম ছোট। বাতাসে এসে পড়েছে। কোথা থেকে এসে পড়েছে কেউ-ই জানে না তবে দেখতে দূর্বল দেখাচ্ছে। ভাইয়া যত্ন করে দু হাতে বুকে জড়িয়ে আদর করতে লাগলো। আমি ভীতু তাই দূরে থেকে দেখতে লাগলাম আগ্রহ নিয়ে। গলা লম্বা সাদা বাচ্চা বক। যেগুলোকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় ডলি বগা (ঢুলি বক) বলা হয়। বগাকে আদর করে ভাইয়া নাম দিল ‘বোগি’! সেই থেকে ভাইয়ার বক বন্ধুর নাম বোগি।
ভাইয়া এবং আম্মা মিলে নিয়ম করে খাবার, পানি এবং রাতে ঘুমানোর জন্য একটা খাঁচার ব্যবস্থা করলো। আম্মা, বকের গায়ে একটু করে লাল রঙ লাগিয়ে দিলেন। খাঁচার ভেতর নরম কাপড় দিয়ে আরামদায়ক করে দিয়েছেন। বোগি, ভাইয়ার কাঁধে চড়ে এদিক ওদিক যায়। উড়তে পারে একটু আধটু। ভাইয়া বিকেল বেলা জমিতে নিয়ে ঘাসফড়িং খেতে দেয় বোগিকে। ছোট মাছ দেয় নিয়ম করে। এছাড়া আমাদের মাছ-ভাতেও বোগি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আম্মা নিয়ম করে গোসল করান। দুই মাসে অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে এক্কেবারে লম্বা গলা আর ধবধবে সাদা দেখতে খুব আকর্ষণীয়!
বোগির বয়স এক বছর পার হয়েছে। দেখে মনে হয় উন্নত জাতের মানে বিদেশি পাখি। বোগি এখন নিয়ম করে নিজে নিজে এদিক ওদিক গিয়ে খাবার খেয়ে আসে, পুকুর হতে মাছ খাওয়া শিখেছে। আশেপাশের সবাই বোগিকে দেখামাত্রই চিনতে পারে আর বলে এটা জাভেদের বোগি।
নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে যায় না। ভাইয়া, স্কুল থেকে এসে বোগি বোগি ডাক দিলেই বোগি এসে হাজির হয় আর ভাইয়ার কাঁধে এসে বসে। নিজ দায়িত্বে বের হবে আর নির্দিষ্ট সময়ে সময়ে বোগি ঘরে এসে যাবে। আমার আম্মা আমাদের যেমনটা শিখিয়েছেন বোগিও ঠিক তেমন শিখেছে।
পাখিরা মানুষের মন বোঝে বোগির কাছ থেকেই শিখেছি। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দূর থেকে আদর করতাম আলতো হাতে। আমরা সব ভাই বোন মানে চাচাতো জেঠাতো ভাই বোন সবাই বোগির বন্ধু হয়ে গেলাম তবে ভাইয়া একটু বেশি। ভাইয়ার সাথে বোগি যেন বন্ধুর মতো আচরণ করতো, আবদার করতো, অভিমান করে ভাইয়ার কোলে লুটিয়ে পড়তো। একদিন সন্ধ্যা হতে চলেছে কিন্তু বোগির আসার খবর নেই। ভাইয়া এবং বাড়ির সবাই মিলে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো।ভাইয়াসহ সবার মন ভীষণ খারাপ। ভাইয়ার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কান্না করে দেবে। অনেকক্ষণ পরে পাশের বাড়ির পুকুর পাড়ে পাওয়া গেল আহত অবস্থায়। খুব বেশি আহত হয়ে ছটফট করতে লাগলো সম্ভবত বন বিড়াল এসে এমনটা করেছিল। অনেক যত্নে আম্মা এবং ভাইয়া বকের সেবা করতে লাগলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত বক বন্ধু বোগি চিরতরে হারিয়ে গেল।