বইয়ের খবর, লেখকের খবর, মেলার খবর

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে বাঙালির প্রাণের বইমেলা। একসময় বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হলেও এই মেলা দেশের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের অনেক দেশে এখন একুশে ফেব্রুয়ারি পালনসহ বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা লেখক-পাঠকদের মধ্যে এক মেলবন্ধনও তৈরি করে। মেলা নিয়ে, বই নিয়ে সুপ্রভাত কথা বলেছে লেখকদের সঙ্গে। নির্দিষ্ট প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন তারা। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

১। মেলায় কী কী বই বের হচ্ছে?

২। কী বিষয় নিয়ে লিখলেন? (প্রবন্ধ ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে)

৩। চট্টগ্রামে প্রকাশনার মান কেমন?

৪। বই বিক্রি কি কমেছে বলে মনে করেন?

৫। একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বই প্রকাশ করা, এটাকে কীভাবে দেখেন?

রহমান বর্ণিল

১। না! অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ এ আমার নতুন কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তদের বিষয়ে প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার যারা পায়, তারা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে নিজেদের শক্তিশালী জায়গা করে নেয়। তারা হারিয়ে যায় না।” কিন্তু গত বছর কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পেয়েই এ বছর বইমেলায় আমার কোনো নতুন বই নেই। কিন্তু নতুন বই প্রকাশিত না হওয়া মানে হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং এবার অন্তত তিনটি নতুন বই প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিপরীত সময় পার করছে। এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক, গবেষকদের যাচ্ছে অত্যন্ত কঠিন সময়। এটা শুরুতেই অনুমান করেই আমি নতুন বই প্রকাশে আমার চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছি।

২। একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের জীবনঘনিষ্ঠ আমার একটা উপন্যাস এবার প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। উপন্যাসটিতে আমি দেখিয়েছি ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক বদলের অজানা ইতিহাস। নব্বইয়ের দশকের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে একদিকে যেমন ৭৫ পরবর্তী দুই দশকের রাজনীতির নানান অপ্রিয় সত্য উঠে এসেছে, তেমনি উপন্যাসের পরতে পরতে চিত্রায়িত হয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারির ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া এবং বিদেশে দত্তক সন্তান হিসেবে বড় হওয়া এক যুদ্ধশিশুর বাংলাদেশে তার জন্মদায়িনীকে খোঁজার মর্মবিদারী কাহিনি।

৩। কিছু কিছু প্রকাশনী অবশ্যই ইদানিং ভালো করছে। চট্টগ্রামের প্রকাশনীগুলো এখনো আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ। ঢাকার প্রকাশনীগুলো যেমন জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে, চট্টগ্রামের কোনো প্রকাশনী এখনো সেরকম হয়ে উঠতে পারেনি। সাম্প্রতিক বইমেলাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে যে দুয়েকটি প্রকাশনীর বই নিয়ে যাগযজ্ঞ ও ইতিবাচক কার্যক্রম চোখে পড়ছে, সেটাও বেশিভাগ চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। ঢাকার প্রকাশনীগুলোর নাম সারাদেশে যেভাবে উচ্চারিত হয়, চট্টগ্রামের দুয়েকটি প্রকাশনীর নামও যেদিন ঢাকাসহ সারাদেশে একইভাবে উচ্চারিত হবে সেদিনই চট্টগ্রামের প্রকাশনীগুলোর গুণগত মানোন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সামগ্রিক হয়েছে বলে দাবি করা যাবে।

৪। মুদ্রিত বই বিক্রি তো অবশ্যই আগের তুলনায় কমেছে। বিগত দুই তিন বইমেলায় যদিও বই বিক্রি কিছুটা আশা দেখাচ্ছে, সেটা নব্বই এবং শূন্যের দশকের তুলনায় একেবারেই নগন্য। তবে বই বিক্রি কমে যাওয়ার নেপথ্যে ই-বুক একটা কারণ হলেও মোটাদাগে সেটাও সবচেয়ে বড় কারণ নয়। বই বিক্রির কমে যাওয়ার বড় কারণ মানুষের পাঠবিমুখতা। আমাদের দেশে লেখক যেভাবে বাড়ছে, পাঠক সেভাবে বাড়ছে না। সবাই লিখতে চায়। কিন্তু যত অনীহা কেবল পাঠে। অথচ লেখক বাড়া পাঠক বাড়ারও ইঙ্গিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম হয়নি। এমনকি বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাধারণের যত অগ্রহ, বইকে কেন্দ্র করে আগ্রহ তার সিকিভাগও নেই। তাই বই বিক্রি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

৫। এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। তবে বছরজুড়ে বই প্রকাশেরও আমি পক্ষে। নতুন পোশাক তো আমরা প্রায়শই পরি। কিন্তু ঈদ, বড়দিন, পুজা, পার্বণে নতুন পোশাক পরার মধ্যে বাড়তি একটা আনন্দ আছে। বইমেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশটাও তাই। বই সারাবছরই পাঠযোগ্য এবং প্রকাশযোগ্য একটা বিষয়। কিন্তু বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বই প্রকাশ হওয়া, বই নিয়ে মাতামাতি হওয়া, লৌকিকতা বা দেখনদারির জন্য হলেও বইমেলায় যাওয়া, বই নিয়ে কথা হওয়া, আলোচনা সমালোচনা হওয়া; এসবকে অপ্রয়োজনীয় বলা যাবে না। এই দেখনদারির হাত ধরে হলেও হয়তো একদিন প্রজন্ম আবার বইমুখী হবে। তাই আমার বক্তব্য হচ্ছে, বই বছরজুড়ে প্রকাশ হোক, আবার বইমেলা কেন্দ্রিকও প্রকাশ হোক। এটা একটা উৎসবের মতো থাক বাঙালির জাতীয় জীবনে। সৃজনশীলতা দিবস কেন্দ্রিক হলেও ইতিবাচক হিসেবে দেখার পক্ষে আমি।

জাহাঙ্গীর আজাদ

১। এবারের মেলায় আমার কোন বই আসছে না। আপনি জানেন, আমি অতিপ্রজ লেখক নই, এটা আমার সীমাবদ্ধতা। সাহিত্যের আঙিনায় দীর্ঘ পরিভ্রমণে আমার মাত্র দুটো কাব্যগ্রন্থ। আমি নিজেকে বাংলা সাহিত্যের একজন নিমগ্ন পাঠকই মনে করি।

২। প্রযোজ্য নয়। কবিতার বাইরে কিছু লেখার ক্ষমতা নেই আমার।

৩। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে চট্টগ্রামের প্রকাশনার মান ঢাকার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ঢাকায় যেমন বটতলা টাইপ প্রকাশনার অভাব নেই, তেমনটা চট্টগ্রামেও আছে। চট্টগ্রামে বাতিঘর, খড়িমাটি, শৈলী, চন্দ্রবিন্দু, তৃতীয় চোখ ও দ্বিমত-এর কাজের মান প্রশংসনীয়।

৪। বলা যায় না বইয়ের বিক্রি কোন সময়েই খুব ভালো ছিলো। আঙুলের কড়ে গোনা যায় এমন কয়েকজন লেখকের বই ছাড়া অধিকাংশ লেখকের বইয়ের বিক্রিবাট্টা পরিচিতজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মেলার স্টলে আমি নিজে যেদিন বসেছি, সেদিন আমার একশোটা বই বিক্রি হয়েছে, আমার অনুপস্থিতির দিনে দশটাও নয়।  তাছাড়া বেশিরভাগ বই প্রকাশের অর্থায়ন লেখককে নিজেরই করতে হচ্ছে, তাই পাঠক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রকাশের পক্ষ থেকে তেমন কোনো গরজ নেই।

৫। মেলা উপলক্ষে বই করার বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। এমনিতেই সারাবছর ধরে তো বই প্রকাশ হচ্ছেই। মেলাকে সামনে রেখে অতিরিক্ত কিছু বইয়ের প্রকাশনা এই খাতে স্রোতের সৃষ্টি করে। লেখকের সাথে পাঠকের সরাসরি যোগাযোগের একটি উপলক্ষ তৈরি হয়।

শামসুল আরেফীন

১। এবারের অমর একুশে বইমেলায় আমার রচনা ও সম্পাদনায় তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: ১. লোককবি ও লোকসংগীত ২. আহমদ ছফা ও অন্যান্য ৩. লোককবি নুরুল আলমের গান (সংগ্রহ ও সম্পাদনা)।

২। লোকসংস্কৃতি ও আধুনিক সাহিত্য নিয়ে আমার উল্লিখিত তিনটি বই।

৩। চট্টগ্রামের প্রকাশনার মান একসময় খুব একটা ভালো ছিল না। বর্তমানে অনেকগুলো ভালো ভালো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অক্ষরবৃত্ত, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশ, খড়িমাটি, তৃতীয় চোখ প্রভৃতি প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশনার মান খুবই ভালো। অক্ষরবৃত্তের প্রকাশনার মান তো আন্তর্জাতিক মানের।

৪। বই বিক্রি তো কখনো সন্তোষজনক ছিল না। তবে বই বিক্রি আগের চেয়ে কমেনি, বরং বেড়েছে বলেই আমার মনে হয়। আগে অফলাইনে বই বিক্রি হতো। এখন অফলাইন ছাড়াও অনলাইনেও বই বিক্রি হয়। রকমারি.কম তো বই বিক্রির জন্য অনলাইনভিত্তিক প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান।

৫। উপলক্ষ্য থাকলে কাজে জোয়ার আসে, কাজ এগিয়ে যায়। একুশের বইমেলা আছে বলে একে কেন্দ্র করে প্রচুর বই প্রণীত ও প্রকাশিত হয়। এটা ভালো দিক।

প্রকাশকের কথা

মঈন ফারুক

১ ও ২। ২০২৫ বইমেলায় প্রকাশিত কবিতার বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আছে- নীরবতা ছিল, আজও থাক, কবিতা, ময়ুখ চৌধুরী, মঁতাজ ও অন্যান্য সনেট, কবিতা, মহীবুল আজিজ, সব ভুল শাহিদের, কবিতা, শাহিদ হাসান। গল্পের বই- লোগাং পাহাড়ে কল্পনার রাইফেল, সৈয়দ মনজুর মোরশেদ, সুনীলের কুকুরটা, কামরুল হাসান বাদল, অংশগ্রহণমূলক হত্যাপদ্ধতি, রিটন কান্তি নাথ, এখনো ইলা মিত্র, জাকির হোসেন। উপন্যাস- নাচের পুতুল, শোয়ায়েব মুহামদ, মাস্টাররিমাউন্ড, সালেহ রনক, কসমোপলিটান হোমিও, রহমান রনি, মান্দাসা, তাপস চক্রবর্তী, শিশুতোষ গ্রন্থ স্বাধীন চাচ্চু, জাহেদ মোতালেব।

৩। চট্টগ্রামের প্রকাশনাগুলোর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানোন্নয়ন ঘটেছে সাম্প্রতিক। দেখা যাচ্ছে নতুন প্রকাশনী আসছে, প্রকাশকরা তরুণ। কাজে ও ভাবনায় নতুনত্ব আনার প্রয়াস লক্ষণীয়। পাশাপাশি পুরোনো প্রকাশনীগুলোও তাদের কাজে পরিবর্তন আনতে দেখা যাচ্ছে। যদিও তাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, পাঠকের জন্য আবার এটা দুশ্চিন্তার। প্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি বা প্রি-প্রোডাকশনে কাজটা এগোইনি। সেটা আগের মতোই আছে।

৪। বই বিক্রি কমেছে মনে হয় না। তবে পাঠক কমেছে। অনেকে কেনে তবে পড়ে না। তবে ভালো বইয়েরও অভাব আছে। বলাবলি করি, লোকজন বই পড়ে না, পাঠবিমুখ হয়ে পড়ছে, অনেকে এটাকে প্রযুক্তিনির্ভরতার কুফল বলেন। আসলে কী ঘটনা তা? না, আরও অনেক কারণ আছে।

একটা তো প্রাথমিক কারণ। ব্যবসা করার জন্য বই করা বা নাম ভাঙানো বই। জ্ঞান বা জানাশোনা বা প্রয়োজনের বই করার লক্ষ্য কি আছে? না থাকলে ভালো বই কমবে। এগুলোতে পাঠকের ভয় থাকে যে, সে প্রতারিত হচ্ছে কি না। পাঠকের আস্থার জায়গাও নষ্ট হয়েছে অনেকখানি। বই নিয়ে নিছক ব্যবসা চেষ্টার একটা দুষ্টচক্র প্রকাশনা ব্যবসাটাকেই নষ্ট করেছে। তুলনামূলক ভালো বইয়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটা কারণ এটা। বাস্তবেও তাই। ভালো বই কমছে। ফলে পাঠক কমছে।

৫। প্রকাশকরা বাংলাদেশে মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান না হয়েও তারা অনেক করে। এটা আমার বিবেচনা। মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে, নিজেই মাঠে নামেন বিক্রির জন্য, অথচ এটা প্রদর্শনীমূলক মেলা। নানা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার প্লাটফর্ম। নানা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা ও মতবিনিময়ের জায়গা। তা না হয়ে জীবন-মরণ বইবিক্রির লড়াইয়ে পরিণত হয়ে আছে বইমেলা। একজন প্রকাশক প্রতিবছর মেলায় (উদ্দেশ্য বিক্রি) স্টল নেন দেশের বিভিন্ন বিভাগীয়, জেলা, উপজেলার মেলায়। সেখানে কর্মী নিয়োগ দেন, বই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। তাতে অনেক ক্ষেত্রে তারা ভর্তুকি দেন। শেষপর্যন্ত অনেকেই ব্যর্থ মনোরথে ফেরেন। আশাহত হয়ে অনেকে ঝরেও পড়েন। এটা ক্ষতি হচ্ছে আরও বেশি। তাদের টিকিয়ে রাখার কোনো বিকল্প চিন্তা আমাদের নেই। বরং স্থানীয়ভাবে তাদের লুটের চিন্তা।