যখন দেশে মবের নামে নৈরাজ্য চালানো হচ্ছে, শিক্ষক থেকে শুরু করে যেকোনো গণমান্য ব্যক্তিকে চরমভাবে অপমানিত করা হচ্ছে সে সময় ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ একটি বিরল ও দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
৩৫ বছরের কর্মজীবন শেষে রাজকীয় বিদায় পেলেন ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুলের সন্তোষ লাল নামের ষাটোর্ধ্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাঁর বিদায়ের দিনটি পরিণত হয়েছিল আবেগঘন মিলনমেলায়।
পত্রিকা মারফত জানা গেছে, এ উপলক্ষে বিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে আয়োজিত হয় বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। উপহার হিসেবে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, প্রধান শিক্ষক, প্রভাতি ও দিবা শাখার শিক্ষকদের পক্ষ থেকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় উপহার। দিবা শাখার শিক্ষক পরিষদের পক্ষ থেকে ৫৪ হাজার টাকা, প্রভাতি শাখা থেকে ৫০ হাজার, দিবা শাখার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ৬০ হাজার ৫৭০, প্রভাতি শাখার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ৫৯ হাজার ১৩০ ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০ টাকাসহ মোট ৪ লাখ ৪৫০ টাকা তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে।
বিদায়বেলায় টাকার পাশাপাশি পেয়েছেন আসবাবসহ নানা উপহার। আবেগাপ্লুত সন্তোষ লাল চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি এমন ভালোবাসা পেয়ে। স্কুল প্রাঙ্গণে তাঁকে স্কাউট দল ব্যান্ড বাজিয়ে গার্ড অব অনার দেয়। শেষে ফুলসজ্জিত গাড়িতে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
বিদায়ের মুহূর্তে সন্তোষ লাল বলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসায় আমি আবেগাপ্লুত। একদিকে খুবই আনন্দিত, আবার অপর দিকে খুব কষ্ট হচ্ছে যে আমাকে স্কুল ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমার মতো একজন সাধারণ কর্মচারীকে এত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানানো হবে, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। দীর্ঘ কর্মজীবনের অনেক স্মৃতি আজ ভেসে উঠছে, এই স্মৃতিগুলো নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।’
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, সন্তোষ লালের বাবা কানু লালও এই বিদ্যালয়ে একই পেশায় যুক্ত ছিলেন। এরপর সন্তোষ লাল বিগত ৩৫ বছর এবং তাঁর স্ত্রী সনজু রানী দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে স্কুলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিন কন্যার জনক সন্তোষ লাল বর্তমানে ফেনী পৌরসভার সুলতানপুর এলাকায় বসবাস করছেন। হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস ও পায়ে সংক্রমণের কারণে তাঁর পক্ষে বর্তমানে দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছিল না। যার কারণে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে চলে যান।
আমাদের দেশে এমন সংস্কৃতি বিরল। ভদ্রলোকের ভাষায় যারা ‘ছোট কাজ’ করে তাদের দেখা হয়, পরিমাপ করা হয় ছোট হিসেবে। কিন্তু আমরা জানি পৃথিবীতে কোনো কাজই ছোট নয়। ছোট হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। আমরা মনে করে থাকি এই মানুষগুলোর সুখদুঃখ থাকতে নেই, ভালোমন্দ থাকতে নেই। এমনকি মানুষ হিসেবে তাদের মূল্যায়নেরও প্রয়োজন নেই। অথচ সমাজে ছোট-বড় সবার দরকার আছে। সব পেশাই সমান। পেশায় ছোট-বড় বলতে কিছু নেই। যেকারণে এ ধরনের মানুষের অস্তিত্বও আমাদের কাছে অনুভব হয় না।
ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুলের পরিচালনা পরিষদ, শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীরা আজ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী দিয়ে চলে না। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সবারই একটা ভূমিকা থাকে। একজন পরিচ্ছতাকর্মীকে সম্মানিত করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই নিজেদের মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। এর ধারাবাহিকতায় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সবাইকে সম্মান প্রদানের চেষ্টা করবে সে প্রত্যাশা করি।
এ মুহূর্তের সংবাদ