মো. আরিফুল হাসান »
রাত তিমির। কুয়াশার চাদর ভেদ করে দুজন মানুষ চলছে। হেমন্তের রাতে, তাদের পায়ের নিচের ভেজা পাতাগুলো মচমচ শব্দে ভাঙছে না। তবু সামান্যতম শব্দে তারা চমকে চমকে উঠছে।
করিমের বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রহিম। রহিম এ বাড়ির কাজের ছেলে। করিম বিয়ে করেছে আজ ছয় বছর হলো। কোলে ছেলেপুলে নেই। গেরামের ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে আমেনাকে। কিন্তু কাজ হয়নি। আসলে ওষুধ উল্টো জায়গায় পড়েছে। অসুখটা করিমের।
করিম মুন্সি এ গায়ের জমিদার। হ্যাঁ, জমিদারই বলা চলে। তবে ইতরশ্রেণির জমিদার। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ জমিজিরাত করিমের নিজের নামের। বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের আমলে কী করে যে এত জাগা-সম্পদ তাদের হাতে চলে এসেছে তা কেউ জানে না। তবে করিমকে দেখে তারা বুঝতে শেখে কী করে ধন-সম্পদ বাড়াতে হয় এবং রক্ষা করতে হয়। ছাব্বিশ দোন খেত করিমের। অথচ কোনোদিন দোকানে বসে এক কাপ চা পর্যন্ত খায়নি। ধান পেকে গেলে, যখন কামলারা সবাই দুই হাতে ধান কাটে করিমের খেতের, তখন করিম পিছা হাতে তাদের পেছনে-পেছনে ঝাড় দেয়। মাটিতে লুকিয়ে থাকা পাখিদানাটুকুও করিম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোলে। নিজের শস্যের একবিন্দু সে ছেড়ে দিতে রাজি নয়।
আশ্বিনের রোদ। আমেনা বধূ হয়ে আসলো এ বাড়িতে । ঘোমটাপরা চামেলি ফুলটা এত বড় বাড়ি দেখে খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল স্বর্গ হয়তো নেমে এসেছে তার কপালে। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই। দু’তিনজন রাখাল। সারাবছর খেত-খামারি দেখার জন্য জনাতিনেক কামলা। আর সকল কামলার কামলা করিম মুন্সি, সে তো নিজেই একশো।
কিন্তু সুখ স্থায়ী হয়নি আমেনার। বিয়ের বছরই শ্বশুরটা মরলো। সেও এক ভয়ানক পিচাশ ছিলো। একমাত্র ছেলে করিমকে নিতে দেয়নি তাকে ডাক্তারের কাছে। লোকে বলে, বুড়োটা চিকিৎসা না করাতে মারা গেছে। করিমের এসব শুনতে লাগে। সে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু বাপটা কী গোঁ ধরল! না, ডাক্তারের কাছে সে কিছুতেই যাবে না। হায়াত না থাকলে মারা যাবে। কিন্তু ওষুধ কিনে অপচয় করার মতো ফালতু লোক সে কিছুতেই নয়। করিমও কি কম কৃপণ! বাবা একবার বলাতেই রাজি হয়ে যেত, কিন্তু আমেনা কি মনে করবে? তবু সে দু’তিন বার সেধেছে, বলেছে, মরার সময়ও কি মানুষের ধনের লোভ যায় না? বৃদ্ধ কষ্টে হেসে বলেছে, না যায় না।
আসলে ধনের লোভ আমেনারও যায় না। তাই তার কষ্টটাও বাড়ে। রাত হলে করিম ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে পাশ ফিরে। রাতের বেলায় করিমের দেহে জ্বরও আসে প্রতিদিন। আমেনা গা-হাত টিপে দেয়। করিম এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কখনো-কখনো বানচিলিকের মতো করিম হয়তো জেগে ওঠে। কিন্তু সে ওঠাকে ওঠা বলে না। আকাশের বিদ্যুৎ চমকেরও স্থায়িত্ব আছে, কিন্তু করিমের তাও নেই।
এভাবে একের পর এক দীর্ঘ দিবস-রাতগুলো পাথর হয়ে গেলে আমেনার মনে বিষ ঢুকতে থাকে। বিষের জ্বালায় আমেনা অস্থির হয়। ছোবল মারে কাজের লোক রহিমের ওপর। আমেনার বিষ রহিমের সারা দেহে ছড়িয়ে গেলে তারা চুপি-চুপি মিল করতে থাকে যোগফলের। একদিন অংক মিলে গেলে তারা পরস্পরের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে নিঃসীম দিগন্তের রাতের অন্ধকারে।
আমেনা হাতটা শক্ত করে ধরে রহিমের। রহিমের পেশিবহুল হাত আমেনার হাতটাকে পেঁচিয়ে ধরে। গ্রামের অন্ধকার ভেদ করে তারা চলছে। রাত বারোটা অবধি তারা হেঁটেছে তিন ঘণ্টা, পাড়ি দিয়ে এসেছে তিন ক্রোশ পথ। পথ তবু তাদের ফুরায় না। তাদের যে আরও বহুদূর যেতে হবে। আরো দূরে, আরো আরো দূরে। অনেক দূরে হারিয়ে যাবে তারা। অনেক দূরে। কোনো এক উপত্যকার তীরে ছোট্ট একটি বাসা বাঁধবে তারা। তাদের কোলজুড়ে খেলা করবে ছোট্ট ফুটফুটে শিশু। সেসব অস্থির ভাবনায় তাদের রাতের পথ তেমন যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় না। তারা পরস্পরের হাত ধরে পরস্পরের হৃৎস্পন্দন অনুভব করে পথ এগোয়।
ভোরের আগে-আগে তারা ছাব্বিশ মাইল পথ চলে এসেছে। আখাউড়া থেকে ভোরের প্রথম ট্রেনে চেপে বসেছে কুমিল্লা গন্তব্য করে। কুমিল্লা এসে তারা সকালের সোনারোদে একটি বাসাও পেয়ে যায়। নদীর ধারে। পালপাড়া ব্রিজের কাছে ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরটি তাদের আশ্রয় হয়ে ওঠে। ধর্মমতে বিয়ে তাদের হয়নি। কিন্তু মনের ধর্মই বড় ধর্ম। স্বামী-স্ত্রীর সংসার করতে থাকে। রহিম সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় আসে। আমেনাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে কোয়েলপাখির মতো। চুমুতে-চুমুতে আমেনার উজ্জ্বল মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।
আমেনার এ সুখও সয় না। একদিন দুপুরে নজর পড়ে আমেনার ওপর বাড়িঅলার। তার নজর তীক্ষè। আমেনাকে বিদ্ধ করে যেন। আমেনা দ্রুত রোদের আঁচলে শাড়ি মেলে দিয়ে দৌড়ে ঘরে পালায়। বাড়িঅলা মিটিমিটি হাসে। আরেকদিন দুপুরের বেলায় বাড়িঅলা এসে আমেনার কাছে জল চায়। বাড়িঅলা চেয়েছে, আমেনা না দেয় ক্যামনে। দরজা খুলে পানি দিতে গেলে ইচ্ছে করে আমেনাকে ছুঁয়ে দিয়েছে বাড়িঅলা। আমেনা দ্রুত দরজা ভেজিয়ে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে। রহিম বাড়ি আসলে সবকিছু খুলে বলেছে রহিমকে। রহিম আশ্বাস দিয়েছে খুব শীঘ্রই তারা নতুন বাসা দেখে ওঠে যাবে। আমেনা যেন সাবধানে থাকে সে ইঙ্গিতও দিয়েছে তাকে। কিন্তু ইঙ্গিতে কাজ হয়নি। সেদিন রাতেই আমেনাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়িঅলা। হাত-পা, মুখ বেঁধে মারতে-মারতে অজ্ঞান করে রহিমকে গাড়ির ডিকিতে তুলে নিয়ে ফেলে দেয় গোমতি নদীর ভাটিতে। তারপর আমেনাকে নিয়ে বিশ্বরোডের এদিকে একটি হোটেলে ওঠে বাড়িঅলা।
রাতভর অকথ্য বর্বর আনন্দে মেতে থেকে। সকালের দিকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় তাকে হোটেলের লোকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। হোটেলে সারাদিন তালাবদ্ধ থাকে আমেনা। কাস্টমার এলে বাইরে থেকে দরজা খুলে দিয়ে আবার বাইরে তালা মেরে দেয়া হয়। হোটেলের চার দেয়ালে আমেনার আকাশ দেখা হয় না। সময়ে-সময়ে খাবার দিয়ে চলে যায় একটা মানুষ। তাও দরজার তল দিয়ে। কে যায়, কে দিয়ে গেল, কিছুই দেখার সুযোগ নেই আমেনার। কেবল মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
ভাবে, পুলিশ এসে একদিন উদ্ধার করবে তাকে। কিন্তু পুলিশ আর আসে না। হোটেলের এ অংশটা ব্যাজমেন্টের নিচে। ফলে পুলিশ আসলেও ওপর দিয়ে সাজানো-গোছানো আবাসিক হোটেল দেখে ফিরে যায়। অথবা পুলিশও জানে ব্যাপারটা। হয়তো এ ব্যবসায় তাদেরও হাত আছে, আছে লাভালাভের হিসাব। তাই নির্বিঘেœ চলতে থাকে নগর সভ্যতা ও পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে নগর কদর্যতা।
করিমের বাপের বংশের আর কেউ নেই। নিজের বংশের কেউ হওয়ার আগেই বউটা ভেগেছে। করিমের কেমন যেন উদাসীন-উদাসীন লাগে আজকাল। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কাজকর্মে মন নেই। জমির ধান শুকিয়ে তামা হতে থাকে। কামলারা বলে, প্রভু, আবার বিয়া করেন। সব ঠিক হয়া যাইবো। কিন্তু কিছুই ঠিক হয় না। করিমের আর বিয়ে করতেও ইচ্ছে জাগে না। কেমন যেন বৈরাগ্যভাব চলে আসে তার ভেতর। কেবল রাত হলে প্রবলভাবে মনে পড়ে আমেনাকে। চোখের তারায় তখন আমেনা ভানুমতি-খেল হয়ে দেখা দেয়। তার রাতের ঘুম চলে যায়। একটা গরম আগুন তখন মেরুদ-ের ভেতর দিয়ে জেগে ওঠে। প্রবলভাবে নাড়ায় তাকে। এক সময় লাভা বিস্ফোরণ করে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ে করিম। আহা, সুখ। এই সুখের জন্যই তো আমেনা আজ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। আগে এমন সুখের মজা বুঝলে তার হয়তো চামেলি ফুলের মতো বউটাকে হারাতে হতো না।
ডাক্তারের কাছে যায় করিম। ওষুধ খায় যৌনশক্তি বাড়াতে। তারপর প্রস্টিটিউটের খোঁজে যায় শহরের দিকে। বাড়ি থেকে ছাব্বিশ কিলোমিটারের পথ আখাউরা। সিএনজি বেবিতে যেতে বড়জোর ঘণ্টাখানেক লাগে। তারপর ট্রেনে ওঠে সোজা কুমিল্লায় গিয়ে নামে। এ হোটেল ও হোটেল করে অনেক মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছে সে। কিন্তু সে তৃপ্ত হয়নি। কোথায় যেন একটা গোপন অতৃপ্তি থেকেই যায় শেষমেশ। যার কাছেই উদগমিত হয়, তার মুখেই সে আমেনার মুখ খোঁজে। কিন্তু আমেনার মতো চামেলিফুলের শোভা কয়জনের আছে। সুখ পায় না করিম। ভ্রমরবিভ্রান্তি নিয়ে এ ফুল থেকে সে ফুলে, ও ফুল থেকে অন্যফুলে হন্যে হয়ে মরে।
করিমের মা মারা গেছে শৈশবে। লোকে বলে জন্মের তিন দিনের মাথায়ই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে সে। এ নিয়ে অবশ্য অনেক কথাআছে। লোকে বলে, বাঞ্জা বুইড়ার ঘরে সন্তান? অসম্ভব। এই সন্তান কোনো কাজের লোকের
-টোকের হইব। এই কলঙ্ক ঢাকতেই নবপ্রসূতি বিষপান করে। আজ করিমের মনে মায়ের কথা ভাসছে ভীষণ। কেমন ছিল তার মা। তার মা কি সত্যিই কারো সাথে শুয়েছিল? সে কি অন্য কারো সন্তান। হলেই বা হলো কি? তার মাকে মরতে হলো কেন? ছেলেসহ মাকে বের করে দিত। বড় হয়ে করিম মায়ের চোখের জল মুছে দিত গভীর মমতায়।
আজ হোটেলে বড় কোনো খদ্দের এসেছে। সাবসুবা মানুষ। হোটেলের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। করিমকে আজ পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। ব্যাপারটি করিমের মনে খুব লাগে। সে জানে, এ রকম সাবসুবা সে দুচারটা কিনে ফেলতে পারে। হ্যা, সে হয়তো সাহেবদের মতো কোট-টাই পরে না। তার হয়তো ফটাস-ফটাস ইংরেজি বলার বিদ্যা নেই। কিন্তু তার ধন-সম্পদের কমতি তো নেই। সে এগিয়ে যায় মেনেজারের দিকে। মেনেজার তাকে অবজ্ঞাভরে দূরে সরাতে চায়। করিম সরে না। বলে, অই লোক কত দিবো। দশ হাজার। করিম বলে আমি দিমু চল্লিশ হাজার। মেনেজার হেসে বলে, কন কি স্যার? আর দুই গুণ বাড়ালে তো আপনাকে সারাজীবনের জন্য দিয়ে দিতে পারি। হ, পছন্দ হইলে সারা জীবনের জন্যই কিন্যা লইয়া যামু।
অন্ধকারে মুখটা ঠাহর হয় না করিমের। এই কি আমেনার মুখ? না, না, এমন হতে পারে না। বিছানার এক কোণে বাসি ফুলের মতো লুটিয়ে আছে আমেনা। আমেনাও চিনতে পারে না করিমকে। না না, এ হতে পারে না। যেই লোক ছয় বছরে ছয়বারের মতো জেগে উঠতে পারে নাই সে কীভাবে মাইয়া মানুষ খুঁজতে হোটেলে আইসবো? না না, এ হতে পারে না। কিন্তু তারপরেও এ-ই হয়। করিম চিনতে পারে আমেনাকে। আমেনাও চিনতে পারে করিমকে। তারা পরস্পর গলাগলি করে কান্দে। আমেনা পায়ে পড়ে করিমের। আমারে তুমি মাফ কইরা দাও। করিম আমেনাকে টেনে বুকে নেয়। আমিও আর নিষ্পাপী নই। কত রমণীর কাছেই তো গেছি, নিজেরে নষ্ট করছি আমিও! চল, এই বার ঘরে ফিইরা চল।
আমেনা বিস্ময়ের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে করিমের মুখের দিকে।