অনুমতি পাওয়া নতুন কেন্দ্রের অধিকাংশ বাদ পড়ছে
থাকছে রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ি ও বাঁশখালী
বিবিসি বাংলা :
দেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে এবং দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর তাই অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে রয়েছে, এমনটাই বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কর্মকর্তারা বলছেন, সামনের দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হতে পারে, বিদ্যুৎখাত নিয়ে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
বাদ পড়ছে কিছু অনুমতি পাওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র
চলমান অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুচ্ছে।
আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছিল দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ এখন চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। যা সম্ভব হয়েছে কারণ ২০০৯ সাল থেকে এবছরের জুলাই পর্যন্ত ১১১ টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে।
কিন্তু কাছাকাছি সময়ে বেশ কিছু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অনুমতি দেয়া হয়েছিল তার একটি বড় অংশ বাদ পড়ছে।
রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ি ও বাঁশখালির মতো নির্মাণাধীন বড় প্রকল্পসহ ২১টি কয়লা-ভিত্তিক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের অনুমতি পেয়েছিল। তার মধ্যে ১৬টিই বাদ পড়তে পারে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘কয়লার এই পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর অনেকগুলো সময়মত আসেনি। সে কারণে যেগুলি সময়মত আসেনি সেগুলো আমরা বাদ দেয়ার পরিকল্পনা করছি। যে সময়ের মধ্যে আমাদের দরকার ছিল সেই সময়ের মধ্যে সবগুলো হয়নি। বেশিরভাগই প্রাইভেট সেক্টরে। কিন্তু বাদ দিতে হচ্ছে কারণ তারা শুরুই করতে পারেনি। কোনগুলোর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, কোনগুলো কোন পর্যায়ে আছে সেটি ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে, রিপোর্ট পেলে তা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করবো।’
বাদ পড়তে পারে এমন কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি, সরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ এবং দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলছেন যেসব কারণে এতগুলো প্রতিষ্ঠান কাজই শুরু করতে পারেনি, ‘কেউ ধরেন তার নিজস্ব ইকুইটি ছাড়া বিভিন্ন সোর্স থেকে লোণ অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। সেটা হয়ত পায়নি। কেউ দেখা যাচ্ছে যে সাইট নির্বাচন করেছিল, পরে দেখা গেছে জমি যখন রেজিস্ট্রি করতে গেছে, বাংলাদেশে যেহেতু জমির স্বল্পতা আছে, অনেক ল্যান্ড ডিসপিউট থাকে, তাই জমি হয়ত সে নিতে পারেনি। কেউ আবার জমি পেয়েছে কিন্তু পরিবেশ বিষয়ে সার্টিফিকেট পায়নি। এসব নানা কারণে তারা স্ট্রাগল করেছে।’
এর বাইরে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যেসব প্রতিষ্ঠানকে এসব কেন্দ্র তৈরির অনুমোদন দেয়া হয়েছে তাদের অনেকেরই বিদ্যুৎ খাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন যে রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ি ও বাঁশখালির মতো বড় বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো ঠিকই থাকছে।
নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আর প্রয়োজন আছে কি?
বাংলাদেশ যেহেতু ইতিমধ্যেই চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম, তা হওয়া সত্ত্বেও নতুন উৎপাদন কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে কিনা সেই প্রশ্ন করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ হোসেন।
তিনি বলছেন, ‘এটার উত্তরের ব্যাপারে সরকার এখন ব্যাকফুটে চলে গেছে। এটার উত্তর তারা দিতে পারছে না। এখানে যেটা হয়েছে যে দুটো জিনিস। সরকারের একটা সেকশন পাওয়ার মিনিষ্ট্রিকে বলেছে যে আমাদের দেশে এরকম গ্রোথ হবে, বিদ্যুতের এরকম ডিমান্ড হবে আরও বিদ্যুৎ উৎপাদনের দরকার হবে। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে যে পরিমাণ গ্রোথ হওয়ার কথা ছিল সেটা আমরা লক্ষ করিনি। বাংলাদেশে কখনো সমন্বিত পরিকল্পনা হয় না। মানে তারা যদি সমন্বিত পরিকল্পনা করতো তাহলে কিন্তু তারা দেখতে পেত যে সেরকম গ্রোথ যেহেতু হচ্ছে না অতএব এরকম পাওয়ার প্ল্যান্টের আমাদের প্রয়োজন নেই।’
চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে
বাংলাদেশে বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ চাহিদার অনুমান এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে বলে মনে করেন অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে গ্রীষ্মকালেও বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াটের উপরে ওঠে না। শীতে সেটি আট হাজারে নেমে আসে।
এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের বেশি কখনোই উৎপাদন করতে হয়নি। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২১ হাজার মেগাওয়াট।
চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ধরা হয়েছে এবং দরকারের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে বিদ্যমান কেন্দ্রের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের বেশিরভাগ সময় অলস পড়ে থাকে। অনেক সময় গ্রীষ্মকালে চাহিদা বাড়ার পরও। তার সাথে এখন যোগ হয়েছে অনুমতি দেয়া প্রকল্প বাদ দেয়ার চিন্তা।
সবমিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বলছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
তার মতে ‘প্রথম বিপত্তি হচ্ছে ডিমান্ড এস্টিমেশন, যে আমার প্রতিবছর কি পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, সেটার বিপরীতে আমি উৎপাদন ক্ষমতার কি পরিমাণ প্রবৃদ্ধি দরকার, তার একটা প্রক্ষেপণ তৈরি করতে হয় এবং সেই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে হাত দিতে হয়। কিন্তু এখানেই ডিমান্ড এস্টিমেশন অ্যাকচুয়াল ডিমান্ডের তুলনায় অনেক বেশি করে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইনের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি অব্যাহত আছে বছরের পর বছর ধরে। যেখানে বিদ্যুতের চাহিদাই নেই, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে, সেখানে এই আইন তারপরেও ব্যাবহার করে সঞ্চালন লাইন, বিতরণ লাইন, পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি অব্যাহত আছে।’
অর্থের অপচয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে ভুল অনুমানের উপর ভিত্তি করে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া মানে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের বোঝা হয়ে ওঠা। অলস পড়ে থাকা এই কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে বলে চুক্তি করেছিল সেটি নেয়ার দরকার না হলেও চুক্তি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ঠিকই দিতে হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হিসাবে গত ছয় বছরে বিদ্যুৎ বিভাগের তাতে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ‘যদি আমি চাহিদার চাইতে বেশি বিনিয়োগ করে ফেলি, তাহলে আমাদের যে মূল্যবান অর্থ রয়েছে যা অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে পারতাম, অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারতাম, সেই অর্থটা সাশ্রয় হতো। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করেই বিনিয়োগ করা উচিৎ। তাহলে অন্যান্য যে খাত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা সেই অর্থটা ব্যয় করে একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অন্যদিকে মানুষের সামাজিক উন্নয়ন করতে পারি।’
সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিষয়ক ২০১০ সালের মহাপরিকল্পনায় কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে বেশি জোর দেওয়া শুরু হয়। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির উৎস হিসেবে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কয়লা ব্যাবহারের সিদ্ধান্ত ছিল।
বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে, তাতে গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, কয়লায় ৩৫ শতাংশ, তেল, বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাকি ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।
তবে ইতিমধ্যেই নতুন পরিকল্পনার দিকে এগুচ্ছে সরকার। সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলছেন সামনের দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হতে পারে।
সেটির একটি ধারণা দিয়ে হোসাইন বলছেন, ‘যেটা হয়েছে যে আমরা টার্গেট করেছিলাম ২০৪১ সালে আমাদের চাহিদা হবে ৫০ হাজার মেগাওয়াটের মতো। যার বিপরীতে আমরা উৎপাদন পরিকল্পনা করেছি ৬০ হাজার মেগাওয়াট। আমরা ধারনা করেছিলাম ২০২০-এ আমাদের চাহিদা হবে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু ১৩ হাজারের উপরে ওঠেনি। সেই কারণে আমরা এখন রিভাইজ করছি এবং উৎপাদন পরিকল্পনাটা আমাদের কমে আসবে। সেটা আমরা রিভিশন করবো।’
গ্যাসে বেশি আগ্রহ?
হোসাইন বলছেন, গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশংকা এবং মূল্য বিবেচনায় কয়লাকে আগে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। তবে এখন তাদের সামনে বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের তালিকায় দেখা যাচ্ছে সিংহভাগই গ্যাস ও সৌর বিদ্যুতের। হোসাইন বলছেন উৎপাদন কমালে কয়লাকেই ধীরে ধীরে বাদ দিতে হতে পারে।
‘কয়লা বা তেলভিত্তিক যেসব পরিকল্পনা আমরা নিয়েছিলাম তা আমরা রিভাইজ করবো। স্বাভাবিকভাবেই যদি কাটছাঁট করতে হয়, যেহেতু কয়লা সবচেয়ে ডার্টি এনার্জি এবং যেটা আমরা শুরুতে চিন্তা করেছিলাম যে কয়লার শুরুতে দাম কম পড়বে কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে কয়লা এবং এলএনজির দাম প্রায় কাছাকাছি। সোলারটাও কিন্তু অনেক কমে আসছে। ২০১০ এর ২০১৬ সালেই সোলার প্যানেলের দাম ৬০ শতাংশ কমে আসছে। লিস্ট কষ্ট চিন্তা করে কয়লাকে আমরা যেভাবে প্রাধান্য দিয়েছি এখন আর সেভাবে দেখছি না। উৎপাদন পরিকল্পনায় যখন আমরা ডাউনসাইজ করবো তখন কয়লাটাকে হয়ত প্রথমেই আমাদের ডাউনসাইজের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হবে।’
বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং কেন্দ্র নির্মাণে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ভুল পথে হাঁটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এর অর্থনৈতিক ক্ষতি যা হওয়ার তা বোধহয় এতদিনে হয়ে গেছে।