প্রেম কী

অমল বড়ুয়া »

সব প্রেম, প্রেম নয়, কিছু কিছু মোহ….
অতলান্ত দীর্ঘশ^াস ছেড়ে ভেজা চোখে আমার নিষ্প্রভ নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বিভু। পরচিত্তবিজাননকারীর মতো আমি তার মনের আন্দোলন দেখছিলাম, পড়ছিলাম বিহ্বল গুমোট হৃদয়াভ্যন্তর, লিলুয়া বাতাসে গরুত্ব পাওয়া তার চিন্তাগুলো। মনে আঁড়ি পেতে শুনছিলাম তার উদ্বাহু প্রশ্নগুলো।
‘প্রেম কী?’ সোঁদা মৃত্তিকায় উত্তর খুঁজছে আমার বন্ধ্যা মনও। মন বিভ্রম, অতিচঞ্চল। মেঘের কালো রঙ মেখে ধাই ধাই করে উড়ছে ভাবনা-চিন্তারা, প্রশ্নোত্তরগুলো। আসলে ‘প্রেম কী?’
একদিন মৃতবৎ জোছনার গাঢ় অন্ধকারে পথ হাঁটতে গিয়ে প্রেমে পড়েছিলাম। উদ্দাম প্রেম, উতাল-পাথাল প্রেম। তার অনবদ্য চাহনীর কাছে, অনিন্দ্য রূপের কাছে, অনিবর্চনীয় মোহের কাছে আটকে পড়েছিলাম। কী এক শুদ্ধতার আবেশ মেখে নির্মল আবেগে জীবনে নতুন করে প্রথম শুনেছিলাম ‘ভালোবাসি’ নামক সেই বহু পুরনো প্রাচীন শব্দটি। মরা বৃক্ষরাজি যেমন করে বসন্তের ছোঁয়ায় নব পত্র-পল্লবে পুনরুত্থানের পরশ পায়, তেমনি সুকুমার নির্জীব সুপ্তমনেও অচেনা হিম-অনুভুতির পরশ দেয় অনন্ত প্রেম। আবেগের কাছে বিবেক আর বিবেকের কাছে আবেগ অর্থহীন। তাই জীবনে আবেগ অব্যাকৃত। জীবনে আছে বিবিধ কষ্ট, হতাশা, দুঃখ-যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, অভাব-অনটন। আর আমার মতো ছিন্নমূল মানুষের কাছে জীবনটা আবেগের চাইতে বিবেকের পরাকাষ্ঠে সুকঠিন। অভাবের তাড়নায় ঘর ছেড়েছি দশ বছর বয়সে; নিজেকে গড়ার প্রত্যয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়েছি কত দিন, কত রাত। মা-বাবার আদর-স্নেহমাখা ভালোবাসার অভাব এখনো বুকের ভেতর বেধেঁ। তাই ভালবাসা শব্দে নস্টালজিক হয়ে পড়ি।
জীবন থেমে থাকে না, চলে আপন নিয়মে। নিজের বন্ধ্যা জীবনে কিছু সুখ ফেরাতে শুরু হয় কর্মজীবন। চাকরির বাজার বড্ড খারাপ। তেমন পুঁজি নাই যে উদ্যোক্তা হব। কাজ শুরু করলাম। শুরু হলো জীবনের নতুন যুদ্ধ। আয় হয় তবে অভাব যায় না। এ যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায়!
আমার নির্মোহ উদাস চোখে চোখ রেখে জয়শ্রী বলেছিল- ‘ভেবো না, আছি সাথে।’ জীবনযুদ্ধের নিদাঘ ময়দানে তার সঙ্গ আমার হতাশার মধ্যেও সুখের পরশ দেয়, বেঁচে থাকার স্বপ্ন-সাহস জোগায়। মনের ভেতর সঙ্গোপনে ভালোলাগার আবেশ ছড়ায়। ভাবতে ভালো লাগে- এই দুর্বিসহ জীবনে অন্তত এমন কেউ আছে, যে আমাকে ভাবে, অনুভব করে, অসীম অভাব-অনটনে সঙ্গী হয় ও সাহস দেয়।
ক্লান্তি আমাকে ছাড়ে না; তবু না হারার প্রত্যয়ে অটল থাকি। কঠিন সময় বাঁধ ভাঙে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের প্রেরণায়। সেই ভবিতব্য ‘জয়শ্রী’। কেবল সেই-ই এখন শক্তি ও স্বপ্ন, বিশ^াস ও ভালোবাসা; অসুখের সুখ, ব্যথার উপশম। ভেবে সুখ পাই- ‘জীবনে এমন কাউকে পেলাম, যে দুঃখ ভালোবেসে দুঃখকে বুক পেতে নেয়।’ আমার মতো জয়শ্রীর পরিবারেও টানাপোড়েন। অভাবে নিত্য বসবাস। সেও ভাগ্যবদলের আশায় চাকরি শুরু করে।
নিরাশার মাঝে আশার পিদিম জে¦লে ভালই কাটছে দিনমান। ভালোবাসার সফল সমাপ্তি বিয়েতে নাকি বিচ্ছেদে.. প্রশ্নটি আপেক্ষিক। কিছু না ভেবে জীবনের চৌদ্দটি বসন্ত পলাশে-শিমুলে রমিত-মতিত হয়ে হৃদয়ে হৃদয় মিশিয়ে নিঃসঙ্গতার রেশ ঝেড়ে যুগল হলাম। হাতে হাত রেখে জয়শ্রী বলেছিল- ‘সাম্রাজ্য বা সম্পদ কিছুই চাই না, তোমাকে ঐশ^র্য করে সারাজীবন রয়ে যাব এই আলয়ে।’ সেই থেকে গেরস্থির বন্দরে নোঙর ফেলে বহু ভরা কটাল আর মরা কটাল স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলেছে সংসারজীবন। এতো প্রেম, এতো মোহ জড়িয়ে আছে জীবনময় রাঙময় অনুভবে।
আমাদের অভাব ভালোবাসার মোহময়তায় ঐশ^র্যে রূপ নিয়েছে। আমাদের ক্ষুধা মায়ার টানে ব্রতে রূপ নিয়েছে। আমাদের সকল ব্যথা আনন্দের ফল্গুধারায় উচ্ছ্বসিত। সুখের সংসার আলোর রোশনাইতে উদ্ভাসিত করে কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। আমাদের সুখ অপার, অনিঃশেষ। বুকের ভেতর তিল তিল করে জমানো ভালোবাসারা মুক্তবিহঙ্গ হয়ে ভাসাচ্ছে মেঘের উড়ুপে। স্বপ্নবৎ এই জগত যেন অপ্সরা গন্ধর্ব কিংবা উপপাতিক দেবতাদের অবিনশ^র দেবলোক। অশেষ উচ্ছ্বাসের হাওয়ায় অতপর জন্ম নিল এক স্বর্ণকেশী মায়াবতী জননী কন্যা। সংসারে অনেক কাজ। ইত্যাকার বহু কাজের ব্যস্ততা জয়শ্রীকে কর্মস্থান ছেড়ে পুরোদমে সংসারী হতে বাধ্য করেছে।
এখন একা আমার আয়ে সংসার চলে। প্রাইভেট কোম্পানীর চাকরি; বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম; বাড়ছে খরচ কিন্তু বেতন সেই প্রাগৈতিহাসিক পালসাম্রাজ্যের ভগ্ন ঐশর্যের মতো একই স্থানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ইদানিং শরীরে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। টানাপোড়নের কারণে ডাক্তার-বৈদ্যমুখি হওয়া দুস্কর। সংসার ও ছেলে-মেয়ের বিবিধ খরচ জোগানোও এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। পেরেশানির অন্ত নেই। খরচ বাঁচানোর জন্য গ্রামে যাব তাও অসম্ভব। কারণ, সেখানেও অন্তহীন সমস্যা। ছোট একটি ঘর নিয়ে কোনোরকমে থাকি। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে এলো আমার চাকরি চলে যাওয়া। মালিক দেউলিয়া হওয়ায় কোম্পানি বন্ধ। আর আমি পড়ে গেলাম গভীর খাদে। ছেলের মেট্রিক পরীক্ষা সামনে; মেয়ে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তাদের টিউশন ফি, স্কুলের বেতন, বই-খাতার খরচ জোগাতে তথৈবচ অবস্থা। একে তো চাকরি নেই। আবার ধার-দেনাও প্রচুর হয়ে গেছে। তারপরও হাল ছেড়ে তো বাঁচা যাবে না। শুরু করলাম রাইড শেয়ার। যা আসে তাতে কোনো রকমে পেট চলে।
নাগরিক ব্যস্ততার পর সাবলেটের বাসায় পেরেশানমাখা জয়শ্রীর মলিন হওয়া বেজার মুখটা বুকের ভেতর শেল হয়ে বেঁধে। রাগ-অনুরাগের নিঃশব্দ কোলাহলে নির্ঘুম রাত কাটে। মাঝে মাঝে আমি নিঃসঙ্গতায় ধ্যানীযোগীর মতো বসে থাকি কর্মহীন; দীনতায়, দারিদ্র্যতায়। তবু ভালোবাসায় আঁচ লাগতে দিইনি। এই যে নিরঞ্জন প্রেম, নিরেট খাঁটি ভালোবাসা! দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের সাধনা!
সংসারের টানাপোড়নে জয়শ্রী ডাক্তারের সহকারীর চাকরি নিলো। কয়েকদিন চাকরি করার পর আর যায় না। ডাক্তার নাকি অবসরে তার সঙ্গ চায়। ডাক্তারের ওপর আমারও খুব ঘেন্না ধরেছিল। তবে ভালো লেগেছে জয়শ্রীর ব্যক্তিত্বের জন্য। এক পরিচিত মহিলা তাকে একটি ক্লিনিক কাম ডায়াগনস্টিক ল্যাবে চাকরি দেয়। রাইড শেয়ারের ফাঁকে আমি প্রতিদিন রুটিন করে জয়শ্রীকে নামিয়ে দিই আবার রাতে ডিউটি শেষ হলে নিয়ে আসি। সংসারের খরচ হু হু করে বাড়ছে। দুইজনের আয় দ্রব্যমূল্যের সাথে তাল রাখতে পারছে না। আমার আয়ও ফিক্সড না, কখনো আয় হয় তো কখনো নিজের পকেটেরটা ব্যয় করে আসতে হয়। দিনশেষে ছেলে-মেয়ের খরচ কিংবা সংসারের প্রয়োজন মেটে না। এ-নিয়ে কথা কাটাকাটি কখনো শব্দের অসীমতার চুড়ায় উঠে যায়। রাগ-অভিমানে ভারাক্রান্ত মনে ক্ষোভ আর ঘৃণারা প্রকট হয়ে উঠে। বাড়তে থাকে দুরত্ব।
অভাবী মানুষের বুকে বিস্তর প্রেম, অসম্ভব স্বপ্ন দেখা মানায় না। টানাপোড়নের দোনোমোনোয় প্রেম কবে ফিকে হয়ে আসে বুঝিনি! কাকডাকা ভোরে জয়শ্রী কাজে যায় ফেরে মধ্যরাতে। ওভারটাইম করে বাড়তি আয়ের আশায়। কর্মক্লান্ত জয়শ্রী নিঃশব্দে আসে-যায়। আমার মুখের দিকে তাকায় না। ঘরময় জিনিষপত্র ও ছেলে-মেয়ের উপস্থিতির মাঝে কেবল আমি শূন্য অদৃশ্য হয়ে পড়ে রই জয়শ্রীর চোখে। ছেলে-মেয়েকে খাওয়ানোর পর মধ্যরাতে নিঃশব্দে হালকা পায়ে ভাতের পাতিল নিংড়ে দেখি, কিছু না পেয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি। ক্ষুধাটা আমাকে তেমন পোড়ায় না। পোড়ায় নিজের অক্ষমতা। নিজের এই অক্ষমতার কথা কারো কাছে বলতে পারি না। উপোসী পেটে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই কিন্তু কাউকে বুঝতে দিই না।
ইদানিং কোনো কোনো রাতে জয়শ্রী বাসায় ফেরে না। আমি ঘামতে থাকি, অস্থিরতা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কিংবা অদ্ভুত শঙ্কায়। মন অস্থির হয়ে ওঠে। মধ্যরাতে মোটরসাইকেলে আমি খোঁজ নিতে তার কর্মস্থলে যাই। দেখি রোগীর সেবায় ব্যস্ত। খোশমেজাজে আছে। সহকর্মীর সাথে কিছু খুনসুটির মিহি শব্দরা বাতাসের ইথারে কানে বাজে। মিনিট-দশেক পর অবারিত নিস্তব্দতার কোলাহল চুরমার করে ৩৮০ ডেসিমেল ভোঁ-শব্দে আমি যন্ত্রযানটি নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিই- ‘জয়শ্রী তো আমার দুঃখ দারিদ্র্যকে জেনেই আমাকে বরণ করেছে। যতই অভাব-অনটন থাকুক না কেন, আমাদের দু’জনের প্রচেষ্টায় একদিন সুদিন আসবেই।’ আমি আশাবাদী মানুষ। আশা নিয়েই বাঁচি। তাই আঁধারেও আলো খুঁজি।
শরীরটা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সে-দিকে দৃষ্টি দেয়ার ফুসরত নাই। মাঝে-মধ্যে বুঝতে কষ্ট হয় রোগ মনে না শরীরে! গতকাল বিকেলে আমার আধোয়া লাল শার্টটি ধুতে হাতে নিলাম। পকেট থেকে ছোট্ট এক টুকরা ধুসর চিরকুট খসে পড়ল। কোনো কিছু না ভেবেই দু’ভাজ করা চিরকুটটি খুলে চোখ বোলালাম, গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা। কাগজের কালো হরফে চোখ আটকে আছে। হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করে চক্কর দিয়ে উঠল। বহুপুরনো বুুকের ব্যথাটা প্রবল হতে শুরু করেছে। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে ওঠেছে। কোথায় যাব কী করব বুঝতে পারছি না। হাঁটতে হাঁটতে সুজিতের বাসায় উঠলাম। ৩২ ইঞ্চি টেলিভিশনে বুঁদ হয়েছিল সুজিত। আমাকে দেখে বসতে দিলো। আমি রিমোট নিয়ে টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো ক্রমাগত পরিবর্তন করে যাচ্ছি। সুজিত বলল- ‘চল কাকু, ভাত খেয়ে নিই।’ ঘড়ির দিকে থাকলাম, রাত দশটা। ভাতের কথা শুনে তিনদিনের উপোসী পেটটা মুচড় দিয়ে উঠল। আমি সুজিতকে পেছনে রেখে দ্রুত রাস্তায় নেমে আসলাম। আমার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। বাসায় আমার ছেলে-মেয়ে একা। তাদের কাছে ফিরতে হবে। আমি কেবল হাঁটছি।
নিঃশ^াস আটকে যাওয়ার আগে আমার মেয়ের শব্দ শুনতে পেলাম- ‘বাবা, তোমার কি খারাপ লাগছে?’ কর্পূর মেঘের মতো আমার চোখে উড়ছে জয়শ্রীর ক্ষয়ে আসা মুখ, তার লেখা চিরকুটের কালো অক্ষর- ‘নতুন সংসার পেতেছি সহকর্মী কাজলের সাথে। তোমার কাছে ফিরব না আর; ভালো থেকো।’ আমার মেয়ে তৃষার আত্মচিৎকারের মধ্যেই আমি সুপ্ততার অতল গহ্বরে ডুবছি কেবল। জয়শ্রী এখন অন্য-পুরুষের বুকে সুখে রমিত। মৃত্যুতে নিমজ্জিত হওয়ার আগে আমারও খুব জানার ইচ্ছে হলো, আসলে প্রেম কী?…মোহ ?