হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর জন্য সমস্ত হাম্দ ও সানা, যিনি আমাদেরকে মুখের ভাষা দিয়েছেন। তাঁর পবিত্রতা, যিনি ভালবাসেন তাঁর পবিত্রচিত্ত বান্দাদেরকে। কৃতজ্ঞতা সে মহান রাব্বুল আলামীনের, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম নবীর উম্মত বানিয়েছেন। যাঁর সাহাবীরা দুনিয়াকে দিয়েছেন নবী প্রেমের দীক্ষা।
অন্তরের অন্তঃস্থলে আমাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস ও অকপট স্বীকারোক্তি যে, আল্লাহ্ই একমাত্র উপাস্য, তিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই, নেই কোন সমকক্ষ। তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যে কারো অংশ নেই। আমাদের সঠিক পথদ্রষ্টা মাহবুবে খোদা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল। আমাদের ধর্ম-বিশ্বাসের এটাই মৌলিকত্ব।
মাহে জুমাদাল উখরার আজ চতুর্থ জুমাবার, বাইশতম দিবস। ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ স্মরণীয় এ দিনটি। মুসলিম জাহানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ দিনটি। কারণ, এ দিনে লোকান্তরিত হয়েছেন ইসলামের প্রথম খলিফা খালীফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদ্বি.)। ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের এক নাজুক মুহূর্তে যিনি শক্ত হাতে হাল ধরায় রক্ষা পেয়েছিল এ শিশু রাষ্ট্র। নবীজির পরে উম্মতের সর্বোত্তম, শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির জীবনাবসান নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক দিন। যাঁর হাত ধরে, প্রিয়নবী (দ.) তাঁর নবুওয়ত প্রচারের কঠিন অভিযাত্রার সূচনা করেছিলেন। প্রথম ঈমান আনয়নকারী মহাপুরুষ হলেন হযরত আবু বকর (রাদ্বি.)। নবীজির কলেমা প্রথম তিনিই পাঠ করার ভাগ্যে সৌভাগ্যবান হন। এভাবে তিনি হলেন প্রথম মুসলমান, প্রথম উম্মত, প্রথম সাহাবী। প্রকাশ্যে ঈমান ঘোষণাকারী হিসাবেও তিনি প্রথম। প্রথম প্রকাশ্যে নামায আদায়কারী হযরত আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। ‘রাশেদীন’ খ্যাত খলীফা চতুষ্টয়ের মধ্যে ইন্তেকালের পর যিনি প্রথম নবীজির পাশেই সমাহিত হওয়ার সুযোগ পেলেন, তিনি সেই প্রিয়তম সহচর, চিরসঙ্গী হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.)। আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে তাঁর প্রিয় হাবীবের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একান্ত সহযোগী হিসাবে সঙ্গ, সাহচর্য দানে ধন্য করেছেন। এ ছাড়া অতি প্রয়োজনীয় পর্যায়ে প্রত্যেক মুহূর্তে তিনি সর্বাগ্রে সাড়া দেয়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জনে ইতিহাসের কিংবদন্তী হয়ে আছেন।
রাসূলে আকরাম (দ.) তেষট্টি বছরের পবিত্র ইহজীবন দু’টি ভাগে বিভক্ত। ১. মক্কা মুআযযমায় তেপ্পান্ন বছর মক্কী জীবন, আর ২. অবশিষ্ট দশবছর অতিবাহিত হয় হিজরতোত্তর মদীনায়ে মুনাওওয়ারায়, এটি মদনী জীবন। তবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সফল জীবনকে গোছানো এবং সামগ্রিক সমাজ, রাষ্ট্র ও উম্মতের ব্যবহারিক জীবন সবটুকুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো শেষোক্ত পর্ব। এ পর্বের প্রারম্ভ হিজরতের মাধ্যমে। ‘হিজরত’ শব্দটি বলতে, লিখতেও শুনতে যত সহজ, তা কার্যত বাস্তবায়ন করার কাজটি এত সহজ ছিল না হিজরতকারীদের জন্য। জীবনকে আমরা যত ভালবাসি না কেন, আমাদের কাছে তা যতই অনাকাক্সিক্ষত হোক, এটা অবশ্যম্ভাবী যে, মৃত্যু হবেই, তা আমাদের ইখতিয়ার বহির্ভূত। আর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় অনিশ্চিত পরবাস গ্রহণ এর চেয়েও বাস্তবতঃ কঠিনতর। সাহাবায়ে রাসূল আল্লাহ্র রাসূলের নির্দেশ পেয়ে হাসি মুখে তা করেছিলেন। সেই কঠিন ও দুঃসহ অভিযানে প্রিয়নবী হিজরতের একমাত্র সঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছেন সেই অকৃত্রিম ত্যাগী বন্ধু, বিশ্বস্থতম সহচর সায়্যিদুনা আবু বকর (রাদ্বি.) কে, যাঁকে নিয়ে সওর গুহায় অবস্থায় করে সেই গুহাকেও প্রিয়নবী অমর ঐতিহাসিকতা দান করেছেন। যে প্রসঙ্গ স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করে এ সত্যে অকাট্যতা আরোপ করেন।
পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা তাঁকে (অর্থাৎ আমার মাহবূবকে) মদদ না যোগাও, তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তো তাঁকে (ইতোপূর্বে) মদদ করেছেন। যখন কাফেরদের অনিষ্ট থেকে তাঁকে বাইরে তাশরীফ নিয়ে যেতে হয়। শুধুমাত্র দু’জন, যখন উভয়ে ছিলেন গুহার অভ্যন্তরে। যখন তিনি (দ.) নিজ দোসরকে বলছিলেন, বিষণœ হয়ো না, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ্ নিজপক্ষ হতে তাঁর ওপর প্রশান্তির অবতারণা করেন। আর তাঁকে এমন বাহিনীর মাধ্যমে সহায়তা দিয়েছেন, যা তোমরা দেখোনি। আর তিনি কাফিরদের (কুফর ও শির্ক’র) প্রচারণা নমিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্রই বাণী সুমন্নত। আল্লাহ্ প্রতাপশালী, প্রজ্ঞাময়’। (৯:৪০)
এ আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.) কে তাঁর রাসূল’র ‘একান্ত সহচর’ হিসাবে উল্লেখ করেন। ইতিহাস ‘গুহার সঙ্গী’ হিসাবে দ্বিতীয় কাউকে স্বীকার করেনি। এ আয়াতের ভিত্তিতে মাসআলা স্থির করা হয়েছে, ‘হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদ্বি.)’র সাহাবীত্ব আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত। হাসান বিন ফযল বলেন, যে ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাদ্বি.) কে রাসূলের সাহাবী বলে অস্বীকার করবে, সে কুরআনের অকাট্য বাণীকে অস্বীকার করতঃ কাফের হয়ে যাবে। (খাযায়েনুল ইরফান : কৃত সদরুল আফাযিল মুরাদাবাদী রহ.) যেহেতু পবিত্র কুরআন সরাসরি নবীর সাহাবী পরিচয় দিয়েছে তাঁকেই। সওর গুহায় প্রবেশকালে সিদ্দীকে আকবর প্রথম ছিলেন। কারণ, গুহার অভ্যন্তরে যদি কোন বিষধর কিছু থেকে থাকে, তখন সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.)ই তার দংশন যন্ত্রণা ভোগ করবেন। এটা নবীজির খেদমতে তাঁর একান্ত অনুরোধ ছিল। গুহার অভ্যন্তরে রাসূলুল্লাহ্ (দ.)র অনুমতিক্রমে সিদ্দীকে আকবরই প্রথম প্রবেশ করলেন। প্রসঙ্গত হযরত ওমর (রাদ্বি.)’র বর্ণনাই অধিকতর প্রণিধানযোগ্য। একবার হযরত ওমর (রাদ্বি.)র নিকট হযরত আবু বকর (রাদ্বি.)র উল্লেখ করা হলে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, যদি আমার সমস্ত আমল তাঁর একটি দিনের এবং একটি রাতের আমলের সমান হতো, তবে কত না উত্তম হতো। রাতটি হলো, যেদিন তিনি রাসূলের সঙ্গী হয়ে হিজরত কালে সওর গুহায় অবস্থান করেছিলেন সে রাত। উভয়ে যখন গুহামুখে পৌঁছলেন, তখন সিদ্দীকে আকবর আরয করলেন, ‘আল্লাহ্র কসম দেই, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ আপনি গুহার ভেতরে প্রবেশ করবেন না, যতক্ষণ আপনার পূর্বে আমি প্রবেশ না করছি। সেখানে যদি (বিষধর) কিছু থাকে, তবে আপনার আগে তা আমাকেই যেন পায়। ‘অতঃপর তিনি গুহায় প্রবেশ করেন’। (মিশকাতুল মাসাবীহ্ পৃ-৫৫৬) এখানেও তিনি প্রমাণ করলেন, জীবনবাজি রেখে নবীজির সেবায় আবু বকরই অগ্রগামী। আর দিনটির প্রসঙ্গে ফারুকে আ’যম (রাদ্বি.) বলেন, ‘যেদিন স্বধর্মত্যাগী দল যাকাত দিতে অসম্মত হয়েছিল, তিনি কঠোর হয়ে বলেছিলেন, ‘যাকাতের পশুর একটি রশিও কেউ দিতে না চাইলে আমি তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবো’। (প্রাগুক্ত) অভিন্ন রা-বীর অন্য এক বর্ণনায় তিরমিযী শরীফে রয়েছে, ‘আমি আর কোনদিনই তার চেয়ে অগ্রগামী হতে পারবো না। হযরত ইবনে ওমর (রাদ্বি.) বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, ‘সমাধির মাটি দীর্ণ হলে প্রথম উত্থিত হবো আমি, এর পর আবু বকর, অতঃপর ওমর’। (মানাকির অধ্যায় : মিশকাত) দেখা যায়, হাশরে-নশরে, জান্নাতে প্রবেশকালেও নবীর সঙ্গী হিসাবে উম্মতের মধ্যে প্রথম থাকবেন হযরত আবু বকর।
ইন্তেকালের পূর্বে আবু বকর (রাদ্বি.) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানালেন, উনি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়তম কারো বিরহে এমন পীড়িত হয়ে পড়েছেন, সেই বন্ধুর সাক্ষাৎ ছাড়া তাঁর ভিন্ন চিকিৎসা নেই। ওফাতের কিছুদিন আগে তিনি প্রিয়নবীকে স্বপ্নে দেখলেন। হুযূর (দ.) তাঁর ঘরে তাশরীফ আনেন। পরনে ছিল দু’খ- শাদা কাপড়। কিছুক্ষণ পরেই তা সবুজ হয়ে গেল। আর এমনভাবে ঝলমল করছিল, তাকানো যাচ্ছিল না। নবীজি সালাম, মুসাফাহা শেষে নুরানী হাত মুবারক তাঁর বুকে রাখলেন। এতে তাঁর বুকের ব্যথা চলে গেল। নবীজি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখনও আমাদের একত্রে থাকার সময় হয়নি’? এটা শুনে তিনি এমনভাবে কেঁদে ওঠলেন, যা ঘরের সবাই শুনলেন। তিনিও বললেন, ‘হুযূর, আমিও যে আপনার বিরহ যন্ত্রণা সইতে পারছিনা। নবীজি বললেন, অস্থির হবেন না, সে সময় ঘনিয়ে এসেছে। পরে তিনি আলী (রাদ্বি.) কে ওফাতের পর তাঁকে গোসল দেয়ার অসিয়ত করেন। জানাযা শেষে তাঁর অসিয়তমত কফিন রওযায়ে মুস্তাফার দরজার বাইরে রাখা হয়। আর নবীজির দরবারে কফিন ভেতরে নেয়ার অনুমতি চাওয়া হলে দরজার বদ্ধ তালা আপনি খুলে যায়। আওয়াজ আসে, বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলিয়ে দাও। এভাবে প্রিয় সাহচর্যে তিনি চিরসঙ্গী হয়ে যান।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।