প্রিয় শের অজ্ঞাত শায়ের

শের, শায়েরি ও শায়ের । পর্ব-৬

 

মাধুর্য, গভীরতা ও প্রকাশভঙ্গির জন্য সারা বিশ্বে সমাদৃত উর্দু ভাষা ও সাহিত্য। জীবনের অভিজ্ঞতা, প্রেম-বিরহ, আশা-নিরাশা এবং সামাজিক বাস্তবতার সহজ অথচ হৃদয়স্পর্শ করার মতো উপস্থাপন আমরা পাই উর্দু শের বা শায়েরিতে।

অনেক জনপ্রিয় শের আছে কিন্তু শায়েরের পরিচয় পাওয়া যায় না। সময়ের সাথে সাথে অনেক শের জনপ্রিয় হয় কিন্তু এর মূল উৎস হারিয়ে যায়। তবে শেরগুলো হারায় না, মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আড়াল হয়ে যায় আসল কবি বা শায়েরের নাম। মানুষ জানতে পারে না আসল রচয়িতার নাম। আরও কিছু শের এতোটাই জনপ্রিয় যে ভুল করে বিখ্যাত কবিদের নামেও চলে এসেছে। আর আসল শায়েরের নাম অজানাই থেকে গেছে।
প্রচলিত শেরগুলিতে এমন কিছু অনুভূতির কথা আছে যা সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে মিলে যায়। মানুষের হৃদয়ে সহজেই জায়গা করে নেয়। এগুলোতে ভালোবাসার গভীরতা, জীবনের বৈরাগ্য বা দার্শনিক ভাব প্রকাশ পায়। অনেকসময় দেখা যায় স্থানীয় কবি বা শখের কবি এমন কিছু লিখেছিলেন যা জনপ্রিয়তা পায়, কিন্তু কবির নাম কোথাও নথিভুক্ত হয় না।

নাম না জানা কবিদের জনপ্রিয় শের উর্দু সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কারণ কবিদের চেয়েও কবিতার বাণীর গভীরতা অনেক বেশি গুরুত্ব পায় মানুষের কাছে।
অজ্ঞাত শায়েরদের লেখা কিছু জনপ্রিয় শের এখানে উপস্থাপন করা হলো।

কিসি কো কেইসে বাতাওঁ জরূরতেঁ আপনি
মদদ মিলে না মিলে আব্রু তো যাতি হ্যায়

[ বাতাওঁ-বলি; জরূরতেঁ-প্রয়োজন বা অভাব
মদদ-সহযোগিতা; আব্রু-সম্মান ]

কীভাবে কাউকে বলি আমার অভাবের কথা
মদদ পাই বা না পাই সম্মাান তো হারাই

মুনতাজির সাব মেরে জওয়াল কে হ্যায়ঁ
মেরে আহবাব ভি কামাল কি হ্যায়ঁ

[ মুনতাজির-অপেক্ষা; জওয়াল-পতন বা ধ্বংস
আহবাব-বন্ধু বা নিকটজন; কামাল-বিস্ময়কর ]

অধীর অপেক্ষা শুধু দেখতে আমার ধ্বংস
দূরের নয়, বিস্ময়কর! এরা আমারই বংশ

কিতাবেঁ ভি বিলকুল মেরি তারাহ্ হ্যায়ঁ
আলফাজ সে ভরপুর মাগার খামোশ

[ কিতাবেঁ-বইগুলো; বিলকুল-ঠিক
আলফাজ-শব্দ; ভরপুর ]

বইগুলো ঠিক আমার মতোই
শব্দে ভরা তবুও নীরব

হামারি জিন্দেগি এক কিতাব হ্যায়
যিসকা হার সফহ্ এক নয়া সবক হ্যায়

[ হামারি-আমাদের; জিন্দেগি-জীবন; কিতাব-বই
যিসকা-যার; সফহ্-পাতা বা পৃষ্ঠা; সবক-শিক্ষা ]

আমাদের জীবনটা একটা বই
যার প্রতিটি পাতা একটি নতুন শিক্ষা

রোজ সোচা হ্যায় ভুল যাওঁ তুঝে
রোজ য়ে বাত ভুল যাতা হুঁ

[ সোচা-ভাবি; তুঝে-তোমায়
ভুল যাতা-ভুলে যাই ]

প্রতিদিন ভাবি, তোমায় ভুলে যাবো
প্রতিদিন আমি ভুলতে ভুলে যাই

ঈদ কে বাদ ও মিল্নে কি লিয়ে আয়ে হ্যায়ঁ
ঈদ কা চান্দ্ নজর আনে লাগা ঈদ কে বাদ

[ মিল্নে-দেখা; আয়ে-এলো
চান্দ্-চাঁদ; নজর-দেখা ]

দেখা করতে এলো সে ঈদের পরে
ঈদের চাঁদ দেখলাম আমি, ঈদের পরে

মৌত আনজামে জিন্দেগি হ্যায় মাগর
লোগ মরতে হ্যায়ঁ জিন্দেগি কে লিয়ে

[ আনজামে জিন্দেগি- জীবনের শেষ পরিণতি
লোগ-মানুষ ]

মৃত্যু জীবনের শেষ পরিণতি, তবে
বাঁচতে গিয়ে মানুষ মরে আজীবন

যো রাত দিন মেরে র্মানে কি র্ক রাহি থে দুআ
ও রো রাহি হ্যায়ঁ জানাযে মেঁ হিঁচকিয়াঁ লে কার

[ যো-যে; র্মানে-মরণে
জানাযে-জানাযা; হিঁচকিয়াঁ-হেঁচকি ]

যে রাত দিন করেছিলো আমার মরণের দু’আ
আমার জানাযায় হেঁচকি তুলে এখন সে কাঁদছে

য়ে যো মেরি মৌত পার রো রাহে হ্যায়ঁ
আভি উঠ্ যাওঁ তো জিনে নাহিঁ দেগাঁ

[ মেরি-আমার; রো-কান্না
জিনে-বাঁচতে; নাহিঁ দেগাঁ-দেবে না ]

এই যে যারা কাঁদছে আমার মরণে
উঠে দাঁড়ালে এখন দেবে না আমায় বাঁচতে

বাল বিখারকে টূটা কররোঁপে যাব কোই মেহজাবিন রোতি হ্যায়
মুঝকো অকস্র খয়াল আতি হ্যায় মৌত কিৎনি হাসিন হোতি হ্যায়

[ বাল বিখারকে-এলোচুলে; টূটা-ভাঙা; মেহজাবিন-সুন্দরী
অকস্র-কেবলই; খয়াল-মনে করা; হাসিন-সুন্দর ]

এলোচুলে ভাঙা কবরের পাশে যখন কোন সুন্দরী আকুল হয়ে কাঁদে
তখন আমার কেবলই মনে হয় মৃত্যু কতই না সুন্দর

বদল যায়ে আগর মালি, চমন হোতা নেহি খালি
বাহারেঁ ফিরভি আতি হ্যায়, বাহারে ফিরভি আয়েঙ্গে

[ বদল-বদলে যাওয়া; চমন-বাগান
বাহারেঁ-বসন্ত; ফিরভি-আবারও ]

বদলে গেলে মালি, বাগান হয় না খালি
বসন্ত আবারও আসবে, বসন্ত বারবার আসবে

সাহিল কে তলবগার য়ে পহেলি সে সমঝ্ লেঁ
দরিয়া-ই-মোহাব্বত কে কিনারা নেহিঁ হোতে

[ সাহিল-তীর; তলবগার-খোঁজা/আনচান; সমঝ্-বুঝতে
দরিয়া-ই-মোহাব্বত-প্রেমসাগর; কিনারা- কূল ]

তীরের জন্য যাদের প্রাণ করে আনচান
তাদের আগেই বোঝা উচিত
প্রেমসাগরের কোন কূল হয় না

ফকির হো কে ভী শাহী কা খু নেহিঁ যাতি
জমিপে র্গিনেসে ফুলোঁকা বু নেহিঁ যাতি

[ ফকির-গরীব; শাহী-অভিজাত; খু-অভ্যাস
জমিপে-মাটিতে; র্গিনেসে-ঝড়ে পড়লে; বু-গন্ধ ]

গরীব হলেও যায় না অভ্যাস আভিজাত্যের
মাটিতে ঝড়ে পড়লেও ফুল হারায় না সুগন্ধ

আপনি খুসী না আয়ে, না আপনি খুসী চলে
লায়ি হায়াৎ আয়ে, কাজা লে চলি চলে

[ আপনি-নিজের; খুসী-খুশি; না আয়ে-আসিনি
হায়াৎ-জীবন; কাজা-মৃত্যু ]

নিজের খুশিমতো আসিনি, যাবও না খুশিমতো
যেটুকু জীবন এসেছি নিয়ে, মৃত্যু এলে যাবো চলে

তেরা মিল্না, তেরা নেহি মিল্না
অউর জান্নাত হ্যায় কেয়া, জাহান্নাম কেয়া

[ তেরা-তোমার; মিল্না-মিলন
জান্নাত-স্বর্গ; জাহান্নাম-নরক ]

তোমার সঙ্গে মিলন, তোমার সঙ্গে বিরহ
জেনেছি আমি স্বর্গ আর নরক কী

অয় সনম, জিস্নে তুঝে চাঁদ সি সুরত দি হ্যায়
উসি আল্লাহ্ নে মুঝ্কো ভি মোহাব্বত দি হ্যায়

[ সনম-সখী; জিস্নে-যিনি; সুরত-রূপ বা চেহারা
মুঝকো-আমাকেও; মোহাব্বত-প্রেম ]

সখী, যিনি তোমায় রূপ দিয়েছেন চাঁদের
সেই ঈশ্বরই দিয়েছেন আমাকেও প্রেম

য়ে বাদল তু ইৎনা না বরস কে ও আ না সাকে
ও আ যায়ে তো ইৎনা বরস ও যা না সাকে

[ বাদল-বর্ষা; ইৎনা-এত; কে-যেন; বরস-বর্ষণ/বৃষ্টি ঝরা ]

হে বর্ষা, এত বেশি ঝরো না যেন ও আসতে না পারে
ও আসলে পরে মুষলধারায় নামো যেন যেতেই না পারে

এই শেরের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা একটি গানের। হতে পারে অজ্ঞাত শায়েরের গজল হতে চয়ন করা হয়েছে এই গানের মূলভাব।

‘ওগোা বর্ষা, তুমি ঝরো নাকো অমন করে
কাছে সে আসবে তবে কেমন করে?
এলে না হয় ঝরো তখন অঝোর ধারে
যাতে সে যেতে চেয়েও যেতে নাহি পারে’

জনপ্রিয় এই গানটি সুর করেছিলেন নচিকেতা ঘোষ আর গেয়েছিলেন মান্না দে।

নয়া সাল মেঁ পিছলি নফরত ভুলা দেঁ
চলো আপনি দুনিয়া কো জান্নাত বানা দেঁ

[ নয়া-নতুন; সাল-বছর; পিছলি-আগের; নফরত-ঘৃণা
দুনিয়া-পৃথিবী; জান্নাত-স্বর্গ ]

অতীতের ঘৃণা ভুলে নতুন বছরে
চলো পৃথিবীটাকে স্বর্গ বানাই

প্রায় এরকম একটা পঙক্তি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়ও পাওয়া যায়।

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’

নতুন বছর মানে নতুন আশা ও শুদ্ধতায় পথচলা।

চয়ন, সম্পাদন ও উপস্থাপন    রুশো মাহমুদ