প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা

জি.বি.এম রুবেল আহম্মেদ »

রিতা ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। টমের সাথে তার সখ্য দিনদিন বাড়ছে। সে আদরের পোষা কুকুরকে শখ করে ‘টম’ বলেই ডাকে। তার স্কুল প্রাঙ্গণেই টমের একক বসবাস। বাবা-মা হারিয়ে ছোট থেকে স্কুলেই বেড়ে উঠছে। অন্য কোন কুকুরকে সে স্কুল গেইটেই ঢুকতে দেয় না। মনে হয়, এখানে তার একক রাজত্ব। রাতে নৈশ্য প্রহরীর ভূমিকায় অফিস কক্ষের গেইটে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন সকালবেলা মূল গেইটে রিতার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে। রিতার পায়ের আওয়াজ পেলেই দৌঁড়ে কাছে চলে আসে। রিতা স্কুলের ক্যান্টিন থেকে কেক, রুটি কিনে। টম তার হাতে খাবার দেখেই লেজ নাড়তে থাকে। সে ছিড়েছিড়ে টমকে প্রতিদিন সকাল-বিকাল খাওয়ায়। ক্লাস সময়ে টম সিঁড়িতে বসে থাকে। শিক্ষার্থীরা ভয় পাবে বিধায় কখনো ক্লাসরুমে ঢুকে না। দূর থেকে তাকে ইশারা দিলে বা টম বলে ডাকলে দৌঁড়ে তার কাছে আসে। ছুটির পর সে টমের জন্য খাবার দিয়ে বাড়িতে ফিরে। শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে টমও রিতার পিছে পিছে বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে থাকে তার হরেক রকম খাবার। রিতার কাছের কোন বান্ধবী নেই। তাই টমই তার বন্ধু। তার বাবা-মাও টমকে ভালোবাসে। তার বাবা মাংসের দোকান থেকে হাড্ডি-মাংস কিনে টমকে খাওয়ায়।
একদিন সন্ধ্যায় রিতা হঠাৎ দেখতে পেল, টম উঠানে নেই। সে এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে, কান্না শুরু করল। নির্ঘুমে কাটল সারারাত। টেনশন হচ্ছে- ‘কোথায় গেল টম?’ পরদিন সকালে সে স্কুলে গিয়ে দেখতে পেল- এ কি অবাক কান্ড! টম প্রতিদিনের মত আজো স্কুল গেটে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে বিস্মিত হয়ে ভাবল, একটা প্রাণীর কতটা স্মরণ শক্তি থাকলে, অচেনা পথে একাই বাড়ি থেকে স্কুলে চলে আসছে পারে। রিতা উৎফুল্ল হলো।
আগামিকাল থেকে রমজান শুরু। প্রায় দেড় মাসের জন্য স্কুল কাল থেকে বন্ধ হবে। তাই আজ শিক্ষার্থীরা উল্লাসে মেতে উঠেছে। কিন্তু রিতার মন ভীষণ খারাপ। ‘স্কুলে না আসলে টমের কী হবে? সে খাবে কী?’ এসব নিজে নিজে ভাবতে থাকে। টম স্কুল গেইটের বাইরে যায় না বিধায় পাশ্ববর্তী কোনো খাবার কুড়িয়ে খায় না। এসসব ভেবে রিতার মাথায় দুশ্চিন্তা ভর কররল। স্কুল ছুটি হলো। এক এক করে সবাই চলে গেল। কিন্তু রিতা যাচ্ছে না । রিতার বিষণ্ন মুখ দেখে
টমও বুঝতে পেরেছে। তাই তার চোখের দুই কোণে অঝরে পানি ঝরছে। রিতা আদর করে টমকে মাথায় হাত ব্লুায়। ক্যান্টিনের ক্রেতার কাছে একশত টাকা দিল রিতা। যাতে প্রতিদিন সকাল-বিকাল খাবার দেয়। কিন্তু তিন-চার দিন পর ক্যান্টিনও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন টমের কী হবে?
এ ভেবে দু’দিন পর সকালে রিতা স্কুলে গেল। গেইটে পা দিয়ে আজ টমকে দেখতে পেল না । এদিক সেদিক তাকিয়ে, টম বলে ডাকল। কিন্তু টম আজ সাড়া দিচ্ছে না। বিস্তৃত স্কুল মাঠ। গাছের শুকনো মরমরে পাতা ঝরছে। এত বড় স্কুল চত্বরে আজ কারো পদচিহ্ন নেই। নিস্তব্ধ চারদিক। রিতা ভয়ে কাঁপছে। কোথাও টমের চিহ্ন মাত্র নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অতিরিক্ত টিনসেট ক্লাসরুমের বারান্দায় যেতেই চোখ পড়লÍ এ কি কান্ড! বেঞ্চের নিচে মাছি ভনভন করছে। শুকনো বালির মধ্যে টম শুয়ে আছে। আজ আর রিতার ডাকে দৌঁড়ে আসছে না। নড়াচড়াও করছে না। রিতা একটু একটু করে সামনে আগায়। কাছে গিয়ে দেখতে পায়- টমের দু’চোখ পেরিয়ে পানি পড়ার চিহ্ন হয়ে আছে। শরীরে কোথাও বিন্দুমাত্র আঘাতের চিহ্ন নেই। লাল টকটকে ঝিলমিল করছে তার অবয়ব। কিন্তু জিহ্বা বের করে আজ শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে না। ততক্ষণে রিতার আর বুঝার বাকী রইল না। যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলÍ ‘কেন তুমি চলে গেলে টম? তুমি যে আমার একমাত্র বন্ধু। এই দেখ দু’দিন পরই তোমাকে দেখতে এসেছি।’ কিন্তু টম আজ তার আর্তনাদে সাঁড়া দিচ্ছে না। রিতা অনেক ভেবেও তার এমন আকস্মিক প্রস্থানের কারণ সন্ধান করতে পারল না। রিতা অনুভব করলÍশুধু মানুষের মৃত্যুই মানুষকে ব্যথিত করে না- কোন উদ্ভিদ ও প্রাণী’র সাথে সখ্যতা হলে তাদের প্রস্থানও খুবই বেদনাবহ হয়। কারণ, পোষা প্রাণীর মৃত্যু- স্বজন হারানোর মতো’ই বেদনাদায়ক!