সাধন সরকার »
২ ফেব্রুয়ারি ছিল ‘বিশ^ জলাভূমি দিবস’। বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর- ডোবা, হাওর-বাঁওড়সহ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো এ দেশের প্রাণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শহরে-গ্রামে এমন অনেক জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। জলাভূমিগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাঁওড়ের অভাব নেই এদেশে। তবে শুধু এগুলো সংরক্ষণ করার যথেষ্ট অভাব রয়েছে! গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। নগরায়ণের চাপেও জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০’ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা বেআইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন অমান্য করে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। এক তথ্য মতে, বিংশ শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত বিশে^র প্রায় ৬৩ শতাংশের বেশি জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ছাড়া চারপাশের বাতাসকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অনেক। শহরাঞ্চলে সুষ্ঠুভাবে বসবাসের জন্য ও নাগরিক জীবনকে বাসযোগ্য করার জন্য জলাভূমিগুলোর ভূমিকা রয়েছে। যদি জলাধারগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং শহরে বড় ধরনের অগ্নিকা- ঘটে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে এক ফোঁটা পানিও কি পাওয়া যাবে! জলাভূমিগুলো তো নগরের তাৎক্ষণিক পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস। ২০১০ সালে যখন ঢাকার ‘ড্যাপ’ (ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল, তখন ভাবা হয়েছিল ঢাকার চারপাশের জলাভূমিগুলো রক্ষা পাবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। রাজধানীতে একসময় প্রায় ২ হাজার পুকুর, ৫২ টি খাল ও অসংখ্য ঝিল ছিল। কিন্তু এর বেশিরভাগই এখন আবাসনের চাহিদা মেটাতে নিচু জায়গা ভরাট করতে করতে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে। তথ্য মতে, শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে বছরে প্রায় ৫ হাজার একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সারা দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪২ হাজার একর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে জলাভূমি ভরাটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বেশিরভাগ খাল ও নিচু জায়গা ভরাট করে ফেলার ফলে এখন একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে। চারপাশের নদীগুলোর সাথে খালগুলোর সংযোগ কাটা পড়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরে গিয়ে খালগুলো যেন মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে! অথচ পরিকল্পনামাফিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে খালগুলো হতে পারত বিনোদনের এক একটি ক্ষেত্র।
একটি জলাধারকে যে কত সুন্দর, আকর্ষণীয় ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে তা ঢাকার ভিতরে হাতিরঝিলের মতো বিনোদনকেন্দ্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়। এ ছাড়া জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বিনোদন কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে এদেশের অনেক হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওরসহ অনেক হাওর জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। আবার অনেক হাওর বিভিন্ন কারণে ধ্বংসও হয়ে যাচ্ছে! পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমির অনেক জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন, বাঁধ, সেচখালের ফলে অনেক জলাভূমি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪৪ লাখ হেক্টর জলাভূমি রয়েছে। অন্যতম বৃহৎ জলাধার চলনবিলের আয়তন আগের চেয়ে অনেক সংকুচিত হয়েছে। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানের জলাধারগুলো বিভিন্ন সময় লিজ বা ইজারা দেওয়া হয়েছে, ফলে লাভের চেয়ে জলাধারগুলোর বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়েছে বেশি! ফলে উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণির বংশবৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি দেশি মাছের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে, বেড়েছে বিদেশি মাছের উৎপাদন।
দেশের জলাভূমি রক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর কাজ করলেও যতই দিন যাচ্ছে ততই জলাভূমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে! এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকা অত্যন্ত জরুরি।
অনেক জলাভূমি বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিচ্ছে, কোনোটা আবার কৃষি জমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে জলাভূমি সংরক্ষণ ও দেখাশোনার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ‘জলাভূমির দেশ’ হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ থেকে একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া মানে জেনে-বুঝে দেশের ক্ষতি ডেকে আনা। তাই জলাভূমি রক্ষায় প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে জলাভূমিনির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জলাভূমিগুলো আমাদের সম্পদ, জীববৈচিত্র্যের আধার। জলবায়ু পরিবর্তনের এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জলাধারগুলো রক্ষা করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কথা গুরুত্বেরসহিত ভাবতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)