সুপ্রভাত ডেস্ক »
এবার পুরোপুরি প্রস্তুত কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত উন্নয়নের আরেক দুয়ার স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর খুলছে এই দুয়ার। যার মাধ্যমে ওয়ান সিটি টু টাউনে পরিণত হবে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সৃষ্টি হবে যোগাযোগ ও শিল্পায়নের নতুন অধ্যায়। মঙ্গলবার দুপুরে এ তথ্য জানান টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ।
তিনি বলেন, টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের রাস্তা ও অ্যাপ্রোচ রোডের যাবতীয় কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সার্ভিস এরিয়ায় কাজ। যা যান চলাচলে কোনো প্রভাব ফেলবে না। ফলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টানেল উদ্বোধন করবেন।
তিনি আরও বলেন, টানেলের নির্মাণকাজকে দুইভাবে ভাগ করা হয়েছে। একভাগ হচ্ছে যান চলাচলের জন্য রাস্তা-অ্যাপ্রোচ রোড তৈরির ব্যবস্থা। যা শতভাগ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ টানেলে ভেতর দিয়ে গাড়ি চলাচলে এখন কোনো সমস্যা নেই। এটি পুরোপুরি প্রস্তুত। তবে সার্ভিস এরিয়ায় কিছু কিছু কাজ বাকি রয়েছে। যেগুলো যান চলাচলের জন্য কোনো সমস্যা নেই।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি চলছে। টোলও আদায় হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। হয়তো আরো কয়েক মাস সময় লাগবে। তেমনি টানেলের কিছু কিছু কাজও বাকি রয়েছে। আমরা দ্রুত এসব কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। তিনি প্রকল্প হিসেবে ধরলে এর কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
প্রকল্পের তথ্যমতে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই নগরীর আদলে ওয়ান সিটি, টু টাউন মডেলে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল।
বহুদিন ধরে টানেলের বিষয়টি আলোচিত হলেও এটি বাস্তবায়নের পর্যায় শুরু হয় ২০১৩ সালে। ওই সময় এক সমীক্ষায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য টানেল অর্থনৈতিকভাবে খুবই জরুরি ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই সমীক্ষায় বলা হয়, টানেলের ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রতিদিন চলাচল করতে পারবে অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন যাতায়াত করার কথাও সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়।
কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পর বিস্তারিতভাবে প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৫ সালের নভেম্বরে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মাল্টিলেন রোড টানেল প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ওই সময় প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশের প্রথম টানেল হিসেবে দুইটি টিউবের একটির বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কো¤পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণ কাজ পরিচালনা করছে। শুরুতে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও নির্মাণ সামগ্রির মুল্যবৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিগ্রহন খরচ বৃদ্ধি এবং করোনাকালে কাজের বহুমুখী ক্ষতি হওয়ায় খরচ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এবং বাকি অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হার সুদে এই ঋণ দিয়েছে।
মুল টানেলের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এছাড়া ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের অ্যাপ্রোচ রোডের পাশাপাশি ৭২৭ মিটারের একটি ওভারপাসও রয়েছে। এই টানেলের সাহায্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চেহারা পাল্টে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়েছে এই টানেল এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। খবর ঢাকামেইল।
এতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার কমার পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প সম্ভাবনা বেগবান হবে। এছাড়া সড়কটি চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে মাতারবাড়ি পাওয়ার হাব, মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দর ও টেকনাফ স্থল বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এর ফলে কর্ণফুলী টানেল ও ছয় লেনের সংযোগ সড়কের সাথে কক্সবাজারের সরাসরি সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হবে।
এদিকে টানেলের সম্ভাব্য উদ্বোধনকে মাথায় রেখে শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সংযোগ সড়কের কাজ শেষ করেছে সওজ কর্তৃপক্ষ। টানেলের সুফল পুরোপুরি পেতে আনোয়ারা উপজেলার চাতরী চৌমুহনীসহ সড়কের তিনটি ¯পটে উড়াল সেতুর কাজ প্রস্তাবনায় এলেও তা এখনই হচ্ছে না। পরবর্তীতে আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হবে বলে জানা গেছে।
সওজের ছয় লেন সড়কের প্রকল্প কর্মকর্তা প্রকৌশলী সুমন সিংহ জানান, সবকিছু হচ্ছে টানেল মেগা প্রকল্পের প্রয়োজন ও বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে। আনোয়ারা থেকে শিকলবাহা ক্রসিং পর্যন্ত ছয়লেনের সড়কের চারলেনের কাজ শেষ হয়েছে। কালাবিবির দীঘি থেকে আনোয়ারা হয়ে চন্দনাইশ কলেজ গেইট পর্যন্ত বিকল্প সড়কের প্রস্তাবনা আছে। প্রস্তাবিত সড়কের নানাদিক যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করা হবে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের উদ্বোধন করবেন। সোমবার (১৪ আগস্ট) সেতু ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই তথ্য জানান।