মোস্তফা কামাল যাত্রা »
এযাবতকালে প্রাপ্ত বাংলা ভাষার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে খ্যাত ‘চর্যাপদ বা চর্যাগীত’ সমূহে চাটগাঁইয়া ভাষার আদি স্বরুপ প্রত্যক্ষ করা যায়। অর্থাৎ চট্টগ্রামী ভাষার প্রকৃত চিত্র অবলোকন করতে হলে আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে ইতোমধ্যে আবিস্কৃত চর্যাগুলোর রচনাভঙ্গিতে। প্রকৃত পক্ষে চর্যাগুলোর সাহিত্যশৈলীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাতে চটগাঁ অঞ্চলের ভাষার বহুমাত্রিক ঐক্য বিদ্যমান। যা খুবই এতদাঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবনাচার ঘনিষ্ট।
ভাষাবিদ ও ভাষা গবেষকগণ খুব জোর দিয়েই বলতে চেয়েছেন যে, চর্যাতেই চাটগাঁইয়া ভাষার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছে। প্রকারান্তরে এটা বিপরিতভাবে প্রামাণ্য যে চর্যাগুলো সমকালীন চাটগাঁ ভাষাতে রচিত হয়েছে। বেশকিছু চর্যায় তো এই ভাবনা হাতে কলমে সত্য। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন আসে; তাহলে যে চর্যাগুলোতে এই প্রবণতা প্রবলভাবে প্রত্যক্ষ হয় সেই চর্যাগুলো কারা কখন এবং কোথায় রচনা করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে এটা সহজেই দ্বিধাহীন চিত্ত্বে বলা যায় চট্টগ্রামের আদি বন্দরগাঁ সংলগ্ন জনপদে প্রতিষ্ঠিত ‘পণ্ডিত বিহার’ বিদ্যাপীঠই হলো সেই স্থান। আলোচ্য সেই বিদ্যাপীঠের সিদ্ধাচার্যগন ৮ম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালের মধ্যে রচনা করেছিলেন। যা বর্তমান আনোয়ারা উপজেলায় ৮ম শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেহেতু এই পণ্ডিত বিহারে আবাসিকভাবে অবস্থান করে সিদ্ধাচার্যগন শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তাই তাদের রচিত চর্যাগুলোতে আনোয়ারার অঞ্চল এবং তার আশেপাশের এলাকার মানুষের জীবনচিত্র, ভূ-প্রকৃতি এবং যোগাযোগের ভাষা অধিক মাত্রায় গুরুত্ব পেয়েছে এবং সন্বিবেশিত হয়েছিল রচিত চর্যাগুলোতে। কথিত আছে যে নেপালের লাইব্রেরিতে চর্যাগুলোর যে সংকলনটি পাওয়া গিয়েছিল তা ‘পণ্ডিত বিহার’ এর অধ্যক্ষ ‘তীলপাদ’ কর্তৃক নেপালে নেওয়া হয়েছিল।
মোদ্দাকথা চাটগাঁ ভাষার ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট (ওচঅ) ভিত্তিক বিশ্লেষণে এতদাঞ্চলে রচিত চর্যাগুলোকে মুখ্য উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এই ক্ষেত্রে ‘চাটগাঁ ভাষা পরিষদ’ এর একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা অতীব জরুরী। যা চট্টগ্রামী ভাষার অবস্থা ও অবস্থান এবং তুলনামূলক পর্যালোচনাকে সু-সংহত করতে গবেষকদের জন্য যেমন সাহয়ক হবে; তেমন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য, উপাদান দালিলীক উপকরণ হিসাবে সংরক্ষণের পথকেও করবে প্রসস্থ। তার জন্য প্রয়োজন ড. জিনোবধি ভিক্ষু কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘আন্তর্জাতিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং সেই নব প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ‘চাটগাঁ বিদ্যা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য, লোক জীবন, লোক শিল্প ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার এবং সংরক্ষণের বিদ্যায়তনিক পাঠ নিশ্চিত করা। তাহলে চট্টগ্রামের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করবে। যাতে করে চট্টগ্রামী ভাষাই নয়; চট্টগ্রামের সামগ্রিক চিত্র তুলে আনার ক্ষেত্র সুসংগঠিত হয়।