সুপ্রভাত ডেস্ক »
চীনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ৮ থেকে ১০ জুলাই দেশটিতে দ্বিপাক্ষিক উপলক্ষে রবিবার (১৪ জুলাই) বিকালে নিজের সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
উল্লেখযোগ্য কিছু প্রশ্নের উত্তর এখানে তুলে ধরা হলো।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার জিরো টলারেন্স নীতি অটল আছে। আমি আপন-পর কিছু জানি না, দুর্নীতি যেই করুক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
আজ রোববার বিকেল ৪টায় গণভবনে তার সদ্য সমাপ্ত তিন দিনের চীন সফর নিয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক সময়ে পিএসসির প্রশ্নফাঁস ও সরকারি কর্মকর্তাদের অন্যান্য দুর্নীতির ঘটনা জনসম্মুখে আসার প্রসঙ্গ উঠলে শেখ হাসিনা বলেন, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা কারো দুর্নীতির ঘটনা অত্যন্ত হতাশজনক এবং তা মেনে নেওয়া যায় না। এরা অন্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা বলবে, আবার নিজেরা হাজার হাজার কোটি টাকা বানাবে, বিদেশে পাচার করবে এটা তো অগ্রহণযোগ্য। ‘(দুর্নীতির বিরুদ্ধে) হাত যখন দিয়েছি, তখন সে যেই হোক তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে না। এখানে আপন – পর কোনোকিছু আমি জানি না, আমি যখন (দুর্নীতির বিরুদ্ধে) জিরো টলারেন্সের কথা বলে আসছি, তখন আমি এটা করেই ছাড়ব।”
আমার বাসায় কাজ করা পিয়ন এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোন ড্রাইভার কত টাকা বানালো, কে কী বানালো, সেটা খোঁজ করে ধরা হচ্ছে বলেই সবাই জানতে পারছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করে গেছে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। এটা বাস্তব কথা। কী করে বানালো এই টাকা। যখন আমি জেনেছি, তাকে বাদ দিয়ে কার্ড সিজ করে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা তো হয়।’
রোববার বিকেলে বঙ্গভবনে সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধরার পর এগুলো চোখে আসে। তাছাড়া তো হয় না। যখনই ধরা পড়ে তখনই আমরা ব্যবস্থা নেই। এটা এক ধরনের মানসিকতা। আরেকটা কথা, সারাবিশ্বেই যে দেশটায় অর্থনীতিতে উন্নতি হয়, সেখানেই এ ধরনের কিছু অনিয়ম হয়, কিছু লোকের হাতে চলে যায় কিছু টাকা-পয়সা বানায়। তারা তো অপেক্ষা করে থাকে। যুগযুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আসলে দুর্নীতি নিচের দিক থেকেই বেশি হচ্ছে। এটা হলো বাস্তবতা। দুর্নীতির উৎসমুখ কোন জায়গায় কোনটা, কয়টা খুঁজবে।
তিনি বলেন, প্রথমে আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। এখন জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে, তাদের থামিয়েছি। এখন আমরা দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছি। দুর্নীতবাজদের ধরছি। এটা চলতে থাকবে।
সরকার প্রধান বলেন, অনেকে আমাকে বলেন, এটা করলে সরকারের ইমেজ নষ্ট হবে। আমি সেটা মনে করি না। যারা অপরাধ করছে, দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে; তাদের ধরতে হবে। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না।
রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না
চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না। অপরাধটা কী? নিজের জীবনবাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছে। বিজয় এনে দিয়েছিল বলে সবাই উচ্চপদে আসীন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধা আর কোটা এক জিনিস না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখানে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা একটা কৌশল। তার মানে হলো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা-নাতি-পুতিরা হলো মেধাবী, তাই না? এটা ভুলে গেলে চলবে না যাদের মেধাবী না বলছে, তাদের হাতে ওনারা পরাজিত। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হয়েছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে, এই কথাটা মনে রাখা উচিত। তাদের মেধাটা কোথায়? সেটা আমার প্রশ্ন।
কোটা নিয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেধা কার কত, সেটা পরীক্ষার প্রিলিমিনারিতে, লিখিত পরীক্ষায়, তারপর ভাইভা হয়। সেই সময় যেটা… সেটা বাস্তবতা তো যদি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয় সেই পাবে। আর সব সময় সব কোটা পূর্ণ হয় না। যেটা বাকি থাকে তা তালিকা থেকেই দেওয়া হয়। অনেক চাকরিতে মেধার তালিকা থেকে দেওয়া হচ্ছে। এ নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু সেখানে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা অগ্রাধিকার পাবে, এটা দিতে হবে।
সরকার কীভাবে চলে সে সম্পর্কে কোনও ধারণা এদের নাই
কোটা বাতিলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলার পরে কোর্ট যখন কোনও রায় দেয় সে বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। সেখানে সমাধান করতে হবে। যারা আন্দোলন করছে, তারা তো আইন মানবেন না, আদালত মানবেন না, সংবিধান কি তারা চিনবেন না। বা একটা কাজ করতে হলে কার্যনির্বাহীর কাজ কী, বিধিমালা বা ধারা থাকে…। একটা সরকার কীভাবে চলে সে সম্পর্কে কোনও ধারণা এদের নাই। কোনও জ্ঞানই নাই। ভালো পড়ালেখা করে, ভালো নম্বর পাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এরা নেতৃত্ব দেবে, তাদের তো ধারণাগুলো দরকার, জানা উচিত। রাষ্ট্র পরিচালনায় কী ধরনের কাজ হয় সেটা কি তাদের জানা আছে? ধারণা তো দেখি না।
তিনি আরও বলেন, যখন আদালতে চলে গেলো, সেটার সমাধান সেখানেই হবে। আদালত তাদের সুযোগ দিয়েছে। তারা আদালতে যাক, বলুক। তা না…। তারা রাজপথে সমাধান করবে। আমাকে বলছে। আদালত যখন কথা বলেছে, রায় হয়ে গেছে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে আমার তো দাঁড়ানোর অধিকার নেই, সংবিধানও বলে না। সংসদও বলে না, কার্যপ্রণালি বিধিও বলে না। কিছুই না। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে ততক্ষণ আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বাস্তবতা তাদের মানতে হবে। না মানলে কিছুই করার নেই।
এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনলে ভালো লাগে না, গায়ে জ্বর আসে
পাকিস্তান আমলের বাঙালিরা যে সমস্যার সম্মুখীন হতো তা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছেলে-মেয়েরা তো সেগুলো দেখেনি। ১৫-২০ বছর আগের কী অবস্থা ছিল সেটাও সকলে জানে না। বিএনপির আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রবাজি-সেশনজট, দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের ছিল না। আজ সকলের হাতে মোবাইল ফোন। সকলে ফটাফট সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ করে আন্দোলন করে। এ মোবাইল ফোন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে কার হাতে ছিল? মোবাইল বেসরকারিভাবে উন্মুক্ত আওয়ামী লীগ।
অনগ্রসরদের সুবিধা দেওয়ার কথা সংবিধানে আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা কি সংবিধানটা পড়ে দেখছে কখনও? আর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? মুক্তিযোদ্ধারা জীবনে কষ্ট করেছে। পঁচাত্তরের পরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিচয় দিত না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছিল। মনে হয়েছিল পাকিস্তানিদের প্রদেশ হয়ে গেছি আমরা। সেইখান থেকে বাংলাদেশ ফিরে এসেছে। জয়বাংলা ফিরে এসেছে। সাতই মার্চের ভাষণ ফিরে এসেছে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনলে ভালো লাগে না! মানে গায়ে জ্বর আসে!
বড় অদ্ভুত লাগে আমার মুক্তিযোদ্ধার নাতনি, সে ভর্তি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। উনি বলেন কোটা থাকবে না। ব্যাটা তুই তাহলে চলে আয়, পড়াশোনার দরকার নেই। তুই মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসাবে কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এখন বলে কোটা লাগবে না। তোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া উচিত। কোটা নেই তোর পড়াও নেই, বাড়ি যেয়ে বসে থাকা উচিত। যদি লজ্জা থাকতো তাহলে আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে বলুক যে কোটা লাগবে না। বিচিত্র এ দেশ। অবশ্যই আমাদের দেশটা বিচিত্র। বিচিত্র মানসিকতা। ছয় ঋতুর দেশ তো, ঋতুও বদলায় বোধও বদলায়।