প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সামাজিক বন্ধন

রায়হান আহমেদ তপাদার »

জ্ঞান ছড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা খুব কম মানুষই বোঝে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে যে কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবারিত জ্ঞানের সাগর থেকে তাদের জ্ঞানের ভা-ার সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের এই বর্তমান আধুনিক বিশ্বে সামাজিক মাধ্যম আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে প্রভাব ফেলছে তা অনস্বীকার্য।
যদিও এই সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের সমাজ, দেশ ও সংস্কৃতির দেয়াল ভেঙে সব মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, কিন্তু এর সবকিছুরই একটা মূল্য আছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর কিছু খারাপ প্রভাবও আমাদের জীবনে দৃশ্যমান। কারণ অন্তঃকরণের-বিচ্ছিন্নকরণের সংযুক্তি ও বৈশ্বিক পরিব্যাপ্তি আমাদের কৃষ্টিকে ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু করে দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা হরণ করছে এবং মানবিক, শারীরিক ও অনুভূতির সাহচর্যকে ভার্চুয়াল যোগাযোগ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করছে। বর্তমান যুগে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতার মাত্রা যে হারে বেড়ে যাচ্ছে তা’ দেখে রীতিমত ভয় হয়। সম্পর্কের এই ধরন ধীর লয়ে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে নগরায়ণ এবং ভূগ্রামের দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে। করোনা কালের সাথে এর সম্পর্ক খোঁজার কোন প্রয়োজন নেই। করোনা কালে মানুষে মানুষে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সঙ্গত কারণে অনেক কমে গেছে। করোনা পূর্বকালে কি যোগাযোগ খুব বেশি ছিলো? সকলে মিলে একত্রিত হয়ে সামাজিক উদ্যোগে সমাজ উন্নয়ন মূলক কাজ, পাড়া প্রতিবেশির খোঁজ খবর নেয়ার মতো অনানুষ্ঠানিক এবং আন্তরিক যোগাযোগগুলো এখন আর দৃশ্যমান নয়।
এই বিভক্তি ক্রমান্বয়ে সমাজ, সম্প্রদায় ধর্ম ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু কি সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক হয়েছে? মানুষে মানুষে সম্পর্ক যতো আনুষ্ঠানিক হচ্ছে, মানুষ সমাজে, পরিবারে থেকেও নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। যে কোন মধ্যবিত্ত পরিবারে গেলে আপনি মানুষের এই একাকীত্ত্বের দৃশ্যমান প্রমাণ পেয়ে যাবেন। এই একাকীত্ব কী প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে। প্রযুক্তি আমাদের যে নূতন সভ্যতা উপহার দিচ্ছে সে সভ্যতায় কি আমরা আত্মকেন্দ্রিক, অসংযমী, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি ক্রমাগত। নীতি বিজ্ঞানে ঔচিত্য অনৈচিত্য নিয়ে অনেক মজার মজার মজার কথা আছে। এর মধ্যে একটি কথা যে কোন মানুষকেই ভাবনার খোরাক যোগায়। যেমন একটি চাকু যখন একজন শৈল চিকিৎসকের হাতে পড়ে তখন চাকুটি মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে উচিত কাজটি করে থাকে আর এই একই চাকু যখন কোন দুর্বৃত্তের হাতে পড়ে তখন চাকুটি, খুন কিংবা যেকোন অপকর্মের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিষয়টি আসলে চাকু যিনি বা যারা আবিষ্কার করেছেন তাদের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করেনা, নির্ভর করে ব্যবহারকারীর মনোভাব এবং উদ্দেশ্যের উপর। প্রযুক্তির যুগান্তকারী আবিষ্কার সেলুলার ফোন, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এ’জাতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণের কথা একটু ভাবুন। সেলুলার ফোন সহ অন্যান্য যে সমস্ত উপকরণের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো আমাদের অতি প্রয়োজনীয় যোগাযোগ, শিক্ষা, গবেষণা, সাহিত্য সংস্কৃতি, তথ্য ভা-ার সৃষ্টিসহ নানাকাজে খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। এই করোনাকালের নিউ নরমাল জীবন ধারায়, অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্যে এসব উপকরণের অভাবনীয় ইতিবাচক ব্যবহার আমরা দেখতে পাচ্ছি।
অনেক মানুষ বাসায় বসে অফিসের কাজ করছেন, সন্তানেরা স্কুল, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করছে। প্রকৌশল, চিকিৎসা শিক্ষা সহ যাবতীয় শিক্ষা ভার্চুয়াল মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এ সমস্ত প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীটা অন্তত থেমে নেই।প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদেরকে কি আইসোলেশনে পাঠিয়ে দিচ্ছে? আমাদের সন্তানদের সুস্থ স্বাভাবিকভাবে, মানবিক অনুভূতি নিয়ে বেড়ে উঠতে দিচ্ছে? আত্মীয় স্বজন, পাড়া, প্রতিবেশিদের অকৃত্রিম সম্পর্ক কি আগের মতো আছে। আপনার সন্তানেরা কি দূর ও কাছের আত্মীয়দের খুব ভালো ভাবে জানে। আত্মীয়দের জন্য হৃদয়ের গহীন থেকে কি আন্তরিক টান অনুভব করে সন্তানেরা। এর উত্তর আমরা জানি, বিশ বছর আগের অবস্থার সাথে তুলনা করলে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধন আর আগের মতো নেই। এ কথাটি আমরা গবেষণা না করেই বলে দিতে পারি। নিজেদের সংসারের দিকে একবার তাকান। আমরা যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে প্রযুক্তি নিয়ে বসবাস করছি, বিষয়টি কি টের পাচ্ছেন? আমাদের পরিবারের সদস্যরা একই ছাদের নীচে বসবাস করছেন কিন্তু বন্ধনের মাত্রা ক্রমাগত ভাবে কমে যাচ্ছে? প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা জগত আছে। সে জগতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে প্রযুক্তির নেশায় সবাই বুঁদ হয়ে আছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেক ভালো বিষয়কে আমরা রপ্ত করছিনা। প্রাইভেসি বিষয়টি তাঁদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে অতিরিক্ত প্রাইভেসিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনা। এই প্রাইভেসি কালচারকে বুঝে না বুঝে আমাদের অনেক পরিবারই অনুসরণ করছে। প্রাইভেসির নামে আমরা এখন আমাদের সন্তানদের অনেক কর্মকা- সম্পর্কে জানার প্রয়োজন বোধ করিনা।
আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রতিটি সমাজের সংস্কৃতি ভিন্ন।আমাদের সংস্কৃতিতে অতি প্রাইভেসি কোনভাবেই খাপ খায় না। প্রাইভেসির বারতাবরণে আপনার সন্তান কিন্তু আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেক পরিবারের সন্তানেরা নিজেদের কক্ষের দরজা বন্ধ করে অতি প্রাইভেসি ভোগ করছে। ওই যে বলছিলাম, পরিবারের প্রতিটি সদস্য নিজেদেরকে একটি দ্বীপের বাসিন্দা করে ফেলছেন। সেই দ্বীপে আছে ফেসবুক, ফেসবুকের ভার্চুয়াল বন্ধুবান্ধব, ফেসবুক ছাড়াও নানা অ্যাপের মাধ্যমে বিকৃত বিনোদন উপভোগ করে নিজেদের রুচি, মুল্যবোধের অধঃপতন ঘটাচ্ছেন দ্রুত। অনভিপ্রেত বিনোদনে যুক্ত থেকে আমরা অনেকেই অকারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। এই ব্যস্ততা আমাদেরকে সামাজিকভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগকে সীমিত করে দিচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতি সবার সাথে আন্তরিক বন্ধন চায়। অধিকাংশ ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের আচরণে প্রচুর সৌজন্য লক্ষ্য করবেন। সৌজন্য, সহবতে অভ্যস্ত পাশ্চাত্যের মানুষেরা, সৌজন্য পালন করে অনেকেই অনৈতিক কর্ম করে থাকে। সৌজন্য সহবত কিছুটা অভ্যাসগত রুটিন কাজ যার মধ্যে অনেকেরই আন্তরিকতা থাকেনা। এরকম কৃত্রিম সৌজন্য আমাদের সংস্কৃতিতে কোনভাবেই মানানসই নয় এবং আমাদের বাঙালি মুল্যবোধে তা’ গ্রহণীয়ও নয়। আমরা মানব উন্নয়নকে অর্থনীতির সূচকের আতশ কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখে থাকি। মানবিক উন্নয়নকে অর্থনীতি যে ভাবে দেখে সমাজবিজ্ঞান সেভাবে দেখেনা। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি অনেকক্ষেত্রে আশীর্বাদ হলেও মানবসম্পর্কের ক্ষেত্রে মোটেও আশীর্বাদ নয়। আমাদের জীবনে সামাজিক মাধ্যমগুলোর অনেক ধরনের নেতিবাচক দিকের মধ্যে রয়েছে,সামাজিক মাধ্যমগুলো মানুষের মাঝে অনলাইন যোগাযোগের মিথ্যে ও অগভীর সম্পৃক্ততা এবং বাহ্যিক বন্ধুত্বকে জিইয়ে রেখে তাদের মানসিক বৈকল্য ত্বরান্বিত করে।
সামাজিক মাধ্যম মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবন থেকে মূল্যবান সময় কেড়ে নিয়ে তাদের আসক্ত করে ফেলে। ফলে তাদের সামাজিক দক্ষতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং অসামাজিক আচরণ বেড়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমগুলো অপরাধীদের জন্য একটা হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে, যা খুব সহজে ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন রকমের অপরাধকর্ম সম্পাদন করে। এবং জটিল মানসিক সমস্যার সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার সংযোগ রয়েছে। এমনকি সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি এই বিশ্বাস ও আস্থার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষ করে তুলেছে অসামাজিক। বস্তুত ভার্চুয়াল যোগাযোগের সুযোগ যত বাড়ছে, মানবসম্পর্ক তত ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। কাছে আসার ছলে মানুষ চলে যাচ্ছে দূরে। সম্পর্কজাল যত বিস্তৃত হচ্ছে, সম্পর্কের মূল্য সম্পর্কে মানুষ তত বেশি বেখেয়াল হয়ে যাচ্ছে। এখন সম্পর্ক আলগা, হৃদয়াবেগরহিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবারিত ব্যবহারের কারণে মানবীয় সম্পর্কের আবেগ ও হৃদয়ানুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে।এছাড়া স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের বন্ধুর সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও প্রকৃতপক্ষে তাকে বন্ধুহীন করে ফেলেছে। শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ নিঃসঙ্গ শুরু করে, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে সে হয়ে পড়েছে চরম নিঃসঙ্গ। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে সে একা। এসব সমস্যা শুধু তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই মধ্যবয়সী এমনকি প্রবীণদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে এই আসক্তি। পুনর্মিলনী বা এ ধরনের অনুষ্ঠানে কারও সময় নেই নির্ভেজাল আড্ডা দেওয়ার। এমনকি মোবাইল কিংবা সেল্ফিস্টিক হাতে ব্যস্ত সবাই ছবি তুলতে। ভাবের আদান-প্রদান গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে পড়েছে ছবি তোলা এবং সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া। চলমান আসরেই সামনাসামনি গল্প ভুলে ছবিতে লাইক কিংবা মন্তব্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে। একই পরিবারের মধ্যে বসবাস করেও প্রত্যেকে যেন আলাদা গ্রহের বাসিন্দা। ছেলেমেয়েরা যেমন ব্যস্ত ভিডিও গেমস, মোবাইল অ্যাপস, কিংবা সামাজিক নেটওয়ার্ক নিয়ে, তেমনিভাবে পিতা-মাতাও ব্যস্ত তাঁদের নিজস্ব জগৎ কিংবা কর্মক্ষেত্র এবং পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ে। এই আসক্তি হয়তো দূরের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়াচ্ছে, কিন্তু শীতল করে তুলছে পারিবারিক বন্ধন ও সম্প্রীতি। এই আসক্তির রাশ টেনে না ধরতে পারলে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।আমি কিন্তু নতুন প্রযুক্তির বিপক্ষে নই। আমিও চাই প্রযুক্তির বিস্তার ঘটুক এবং মানুষ এগিয়ে যাক। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে তার মূল্যায়ন করা অত্যাবশ্যকীয়।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স