আশরাফুন নুর »
‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’
রবীন্দ্রনাথ এখানে নবীন, তরুণ, তারুণ্য শক্তিকে বোঝাতে ‘সবুজ’ ব্যবহার করেছেন। এই সবুজ রং নতুন জীবন কিংবা শক্তি, উর্বরতার প্রতীক। আবার সবুজ শান্তি ও বিশ্রামের রংও বটে। এই সবুজ ক্লান্তি হরণ করে আমাদের তরতাজা করে। তারুণ্যের প্রতীকও এই সবুজ। সবুজ মানেই যেন কেমন কচি কচি গন্ধ। এই সবুজের সাথে তারুণ্যের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
প্রমথ চৌধুরীর মতে- সবুজ বর্ণ সকল বর্ণের মধ্যমণি। অন্য সব বর্ণ সবুজ বর্ণেরই বৈচিত্র্যময় রূপো’ছটা। বিভিন্ন রঙের রূপ, স্বরূপ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তিনি সবুজ বর্ণকেই শ্রেষ্ঠত্বের উপাধি দান করেছেন।
সবুজ নানা বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। সবুজের প্রধান বৈশিষ্ট্য সে কাঁচা, সরস ও নবীন। সবুজের এ বৈশিষ্ট্য শাশ্বত ও চিরন্তন। এই সবুজ বর্ণ অন্য সকল বর্ণের মধ্যে যেভাবে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে, তেমনি তরুণরাও সমাজের সব বয়সের মানুষের ও সকল যুগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। মূলত ‘সবুজ’ বলতে প্রমথ চৌধুরী তারুণ্যকেই তথা যৌবনের অধিকারী নবীন কর্মচঞ্চল সম্ভাবনাময় সমাজ সদস্যদেরকেই ইঙ্গিত করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে ‘সবুজ পত্র’ প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত একটি পত্রিকা। বলা হয়ে থাকে সাহিত্য ক্ষেত্রে এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এটি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান সাময়িক পত্রিকা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘সবুজ পত্র’ এক বিশেষ অবস্থান দখল করে আছে।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তারুণ্যের উপাসক। আর তারুণ্যের সবুজ বলেই তরুণ-নবীনদের জন্য পত্রিকা সম্পাদক করে তার নাম রেখেছেন ‘সবুজ পত্র’। এই নামকরণের পক্ষে তিনি নিজেই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তিনি মনে করেন- বাংলাদেশ সবুজেরই দেশ এবং এ দেশের স্থায়ী রংও সবুজ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ ঋতু বদলের সাথে সাথে তার রং বদলায় না। বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত সবুজেরই সমারোহ।
প্রমথ চৌধুরী আশা ব্যক্ত করেছেন- ‘আমাদের আশা আছে যে, সবুজ ক্রমে পেকে লাল হয়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের অন্তরের আজকের সবুজ রস কালকের লাল রক্তে তবেই পরিণত হবে, যদি আমরা স্বধর্মের পরিচয় পাই এবং প্রাণপণে তার চর্চা করি।’
আমরা অষ্টপ্রহর এই সবুজ বেষ্টনীর মধ্যেই বসবাস করছি, যার প্রভাব রয়েছে আমাদের দেহ-মনে। ফলে আমাদের মনও সবুজ। আর সবুজ মানে সতেজ, প্রাণবান, প্রাণদীপ্ত। অতএব সজীবতা, সরলতা, প্রদীপ্ততা ও সরসতাই হচ্ছে বাঙালির মূল শেকড় ও স্থায়ী রূপ। সবুজ পত্র পত্রিকায় যা লেখা হয়, তা তেমনি সহজ ও সরল। তাছাড়া লেখক হিসেবে যারা সবুজ বা তরণ তাদের লেখাতেই সবুজ পত্র ভরপুর হয়ে ওঠে।
সবুজ বলতে ‘সবুজ পত্রে’র সম্পাদক তারুণ্যকে বুঝিয়েছেন। প্রকৃতিতে সবুজ বেড়ে ওঠে উন্মুক্ত উদার আলো বাতাসে। খোলা হওয়ায় সে তার পূর্ণ রং ছাড়ায়। কিন্তু সবুজকে আলো থেকে সরিয়ে নিলে তথা সূর্যের স্বাভাবিক আলো থেকে সরিয়ে নিলে তা বিকৃত রং পায়, শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। তেমনি তারুণ্যের যদি স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া না হয়, স্বধর্ম বিকশিত করে উন্মুক্ত উদারভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ না দেওয়া হয়, তবে তরুণের জীবনরস শুকিয়ে বিবর্ণ হতে বাধ্য।
‘সবুজ পত্র’ ছিল তৎকালীন সাহিত্যপত্র হতে স্বতন্ত্র অর্থাৎ গতানুগতিক, প্রথাসিদ্ধ চিন্তাধারা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। প্রাচীন সংস্কারধর্মী অস্পষ্ট ভাব-চিন্তা ও অনুদার রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন কোন লেখাই এতে প্রকাশিত হতো না। ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকা যুগোপযোগী নতুন নতুন বিষয় এবং প্রচলিত বিভিন্ন সাহিত্যিক বা দার্শনিক তথ্য ও তত্ত্বের প্রগতিশীল আলোচনার একমাত্র বাহন ছিল।
বাংলাদেশের সাহিত্য আন্দোলনের ¯্রষ্টাও বটে এই ‘সবুজ পত্র’। সমকালীন বাংলাদেশের যুবসমাজকে নতুন উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ করা, নব পরিকল্পিত পথে পরিচালিত করাই এ পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য। জীর্ণ-জরাগ্রস্ত, দিকভ্রান্ত দেশে ‘সবুজ পত্র’ নবজীবন ও নবযৌবনের সংবাদ পরিবেশন করবে এটাই ছিল এই পত্রিকার ঘোষণা।
প্রমথ চৌধুরীর মতে কোন বিশেষ উদ্দেশে সাহিত্য রচিত হলে তা সংকীর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সাহিত্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। যার চিন্তা সমাজ চিন্তার সাথে ষোলআনা মিলে যায়, তার কোনো বক্তব্য নেই। বিরোধেই মন জেগে ওঠে, জাগ্রত মন হতেই সৃষ্ট হয় সাহিত্য।
‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের কথ্য ভাষায় বাংলারই রূপ-স্বরূপকে প্রতিফলিত করতে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি দেশের মানুষকে স্বদেশীয় ঐতিহ্যে অন্তর থেকে সুশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত ও পরিশীলিত করার মধ্যে দিয়ে কর্ম প্রেরণায় উদ্দীপিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন এ পত্রিকার মাধ্যমে।
বাংলা সাহিত্যের নানান বিষয়ের উত্থান ঘটাতে সবুজ পত্রের অপরিসীম অবদান রয়েছে। সবুজ পত্র নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন- ‘… এর প্রথম দান প্রমথ চৌধুরী বা বীরবল। দ্বিতীয় দান চলিত ভাষার প্রতিষ্ঠা। তৃতীয়- এবং হয়তো বা মহত্তম দান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রমথ চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথ, এ দু’জনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো সবুজ পত্রের, প্রথম জনের আত্মপ্রকাশের জন্য, দ্বিতীয় জনের নতুন হবার জন্য।…’
বাংলা সাহিত্যে এই চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলা সাহিত্যের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে নতুনত্ব এনেছিলেন। সাহিত্যাঙ্গনে প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ‘বীরবল’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবুজপত্র কেবলমাত্র বাংলা ভাষাকে সাধু ভাষার প্রভাব মুক্ত করে চলিত তথা কথ্য ভাষাকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যই অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।