প্রথিতযশা সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া

ড. স্বর্ণময় চক্রবর্ত্তী »

অবিভক্ত ভারতের সময়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামও একটি উল্লেখযোগ্য জায়গায় উন্নীত হয়ে উঠেছিল। এটি যাঁর কারণে সম্ভব হয়েছিল তিনি চট্টগ্রামের কাট্টলির জমিদারনন্দন সঙ্গীতাচার্য সুরেন্দ্র লাল দাস। যাঁকে তখন সবাই ঠাকুর্দা নামেই সম্বোধন করতেন। ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম আর্য্য সঙ্গীত সমিতিতে সুরেন্দ্র লাল দাস পূর্ব বঙ্গের প্রথম সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর একান্ত আগ্রহে এই সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ সত্যিকারের মহাবিদ্যালয়ে রূপ লাভ করেছিল সেই সময়। সাধারণ ঘরের ছেলে-মেয়েদের জন্য সহজে সঙ্গীত শিক্ষা লাভের একটি সুযোগ যেমন তিনি সৃষ্টি করলেন, একই সাথে আরও একটি ঐতিহাসিক কাজ তিনি শুরু করেছিলেন, সেটি হল চট্টগ্রাম শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মেলনের আয়োজন। এই সম্মেলন তৎকালীন উপমহাদেশ খ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের কাছে একটি আরাধ্য সম্মেলনে রূপ লাভ করেছিল। এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত গিরীজাশংকর চক্রবর্ত্তী, উস্তাদ মুশতাক আলী খাঁ, পণ্ডিত রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, পণ্ডিত রাধিকা মোহন মৈত্র, পণ্ডিত গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়, পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, নৃত্যাচার্য্য উদয় শংকর, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্ত্তী, পণ্ডিত রবি শংকর, পণ্ডিত এ টি কানন প্রমূখ। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এই বিদ্যাপীঠকে সঙ্গীত আশ্রম আখ্যা দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে গড়ে ওটা চট্টগ্রামের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাঙ্গনটি একসময় দেশবিভাগ জনিত কারণে তার ঐতিহ্য হারিয়ে যেন টিম টিম করে জ্বলছিল কখনো কখনো। সেই সময়ে যাঁরা চেষ্টা করেছিলেন হারানো ঐতিহ্য যথাসম্ভব ধরে রাখবার জন্যে তাঁদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা জানাই। অবশেষে ১৯৬৫ সালে কোলকাতা থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথার্থ তালিম নিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন একজন অনন্য শিল্পী সঙ্গীতজ্ঞ। সত্যিকারের প্রাণস্পন্দন ফিরে এলো মৃতপ্রায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাঙ্গনে এবং যিনি অচিরেই একজন সফল সঙ্গীত গুরু হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করলেন। সাধারণ শিক্ষায় তেমন শিক্ষিত না হয়েও বর্তমান যুগের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকের চেয়েও নম্র, ভদ্র, মার্জিত ও উন্নত রুচিবোধ এবং সুন্দর মানসিকতা সম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব হিসেবে যাঁকে পেয়ে চট্টগ্রাম তথা সমগ্র বাংলাদেশ গর্ব বোধ করতো তিনি উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার আব্দুল্লাপুর গ্রামে পিতা নিকুঞ্জ বিহারি বড়ুয়া ও মাতা বিরলা বালা বড়ুয়ার একমাত্র সন্তান নীরদ বরণ বড়ুয়ার জন্ম ১৯৩৬ সালে। গ্রামে বিভিন্ন পার্বন উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে শৈশবকাল থেকেই নীরদ বরণ বড়ুয়ার গানের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। কিন্তু এরইমধ্যে নীরদ বরণ বড়ুয়ার পিতৃবিয়োগ ঘটে। মৃত্যুপূর্বে অসুস্থ পিতা, মা-কে অনুরোধ করলেন, – নীরদ বরণকে যেন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিদেশে পাঠানো হয়। না হয় পাড়ার বখে যাওয়া ছেলেদের সাথে মিশে ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাঁর মা বিরলা বালা মৃত্যুর পূর্বে স্বামীকে দেওয়া কথা অনুযায়ী মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে কোলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের কাছে নীরদ বরণকে। সেখানে গিয়ে নীরদ বরণ বেশিদিন মামাতো ভাইদের গলগ্রহ হয়ে রইলেন না। মাত্র ষোল দিনের মাথায় খুঁজে নিলেন ১৫০ টাকায় একটা বেকারিতে ক্যাশিয়ারের চাকরি। মোটামুটি একটা একটা কিছু ভরসা পাওয়ার পর আসল উদ্দেশ্য সঙ্গীত শেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তীর্থস্থান বলে খ্যাত কোলকাতায় থেকেও যদি শিখতে না পারা যায় তাহলে জীবন বৃথা। ভাবতে ভাবতে এরইমধ্যে পরিচিত বন্ধুদের কাছ থেকে সন্ধান পেলেন প্রথম সঙ্গীত গুরু নাটু ঘোষের। শুরু হল ব্যাকরণিক সঙ্গীত শিক্ষা। আরো কিছুদিন পর নতুন ভাবে পরিচিত হলেন কেন্দ্রীয় সরকারি ভবনের চাকুরে ক্যাশিয়ার মুখার্জি বাবুর সাথে। তিনি নীরদ বরণের রাগ প্রধান গান শুনে মুগ্ধ হলেন এবং তাঁদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইবার সুযোগ করে দিলেন। ক্রমে মুখার্জি বাবুই তাঁর গুণগ্রাহী হয়ে উঠলেন এবং এক সময়ে নীরদ বরণ তাঁর প্রথম আবাসস্থল বাটানগর ছেড়ে চলে এলেন কোলকাতার কেন্দ্রস্থল ধর্মতলায়। কারণ মুখার্জি বাবু ততদিনে তাঁর অফিসের বিশাল ভবনের এক কোণায় নীরদ বরণকে চায়ের দোকান খোলার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে খদ্দেরের কোনো অভাব হলো না। কারণ অফিসের প্রায় সবাই ততদিনে নীরদ বরণের বাঁধা খদ্দের হয়ে গেছে। কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় রাখতে হলো আরো একজন সহযোগীকে। এবারে দৈনিক দুশো/আড়াইশো টাকার বেচা-বিক্রি হতে লাগলো নিয়মিত। মাস শেষে হাজার টাকা লাভ পেতে লাগলেন। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে সঙ্গীতের উন্নতির চিন্তাটাও চেপে বসলো। ধ্রুপদ শেখার জন্য গেলেন বিখ্যাত ধ্রুপদিয়া অনিল কুমার ঘোষের কাছে। তাঁর কাছে একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে তালিম চললো আরো সাত বছর। এবারে মাথায় ঢুকলো সনদপত্র নিতে হবে। ভর্তি হলেন অল ইণ্ডিয়া মিউজিক কলেজে। সেখানে তালিম শুরু হল কলেজের প্রিন্সিপাল সঙ্গীতাচার্য প্রফুল্ল কুমার সেন মহাশয়ের তত্বাবধানে। জন্মসূত্রে সেন মহাশয়ের আদি বাসস্থানও চট্টগ্রামে।
কালক্রমে গুরুর একান্ত স্নেহধন্য হয়ে উঠলেন নীরদ বরণ বড়ুয়া। ছাত্রের একাগ্রতা ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিবিড়ভাবে তালিম দেওয়া শুরু করলেন সেন মহাশয়। এভাবে সেই তালিম চললো দীর্ঘ আরো সাত বছর। অবশেষে সঙ্গীতবিশারদ প্রাপ্ত হলেন নীরদ বরণ বড়ুয়া। গুরু শিষ্যকে বললেন কোলকাতায় থেকে যেতে এবং অল ইণ্ডিয়া মিউজিক কলেজে শিক্ষকতা শুরু করতে। কিন্তু মা এবং জন্মভূমির প্রতি কর্তব্যবোধে নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না নীরদ বরণ বড়ুয়া। যদি ওখানেই থেকে যেতেন তাহলে আজকের ইতিহাস হয়তো অন্যরকমভাবে লেখা হতো। যা হোক, তিনি চলে আসলেন স্বভূমি চট্টগ্রামে। এসেই দৃষ্টি কাড়লেন চট্টগ্রামের সেই সময়কার সাংস্কৃতিক অবিভাবক ডা. কামাল এ খান সাহেবের। তিনিই তখনকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, বেতারে এবং আর্য্য সঙ্গীত সমিতি সঙ্গীত বিদ্যাপীঠে প্রতিষ্ঠিত করা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর নিজের বাসায় রেখে দিলেন সঙ্গীত বিশারদ নীরদ বরণ বড়ুয়াকে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যাঁর কথা স্মরণ হওয়া মাত্র অত্যন্ত শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়তেন উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া।
উস্তাদজী যখন আর্য্য সঙ্গীত সমিতি পরিচালিত সুরেন্দ্র সঙ্গীত বিদ্যাপীঠে অধ্যক্ষরূপে গেলেন তখন ছাত্র-ছাত্রী খুব একটা ছিল না। তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা সর্বোপরি সঙ্গীতাকর্ষণে বিদ্যাপীঠে তখনকার দিনে প্রায় ৫০০-তে উন্নীত হলো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চায় ফিরে এলো নতুন জোয়ার। কথাগুলো জেনেছি চট্টগ্রামের প্রাজ্ঞজনদের কাছ থেকে। বর্তমানে আর্য্য সঙ্গীত থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের প্রায় সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা তাঁর গড়া শিষ্য। এক কথায় বলতে গেলে, চট্টগ্রামের বর্তমান সঙ্গীতানুকুল পরিবেশটা তৈরির কারিগর উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন সাহেবের ভাষায়, উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া চট্টগ্রামের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতটাকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাজধানী খ্যাত কোলকাতার সাথে যেন নতুন করে যুক্ত করেছেন। তাঁর গড়া শিষ্য বর্তমানে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ নয় গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছেন সুনামের সাথে।
সুদক্ষ গায়ক হিসেবে সমীহ আদায়কারী একজন শিল্পী ছিলেন উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। তাঁর পূর্বসূরী পণ্ডিত বারীন মজুমদার, উস্তাদ মুনসী রইস উদ্দিনের পর বিগত দশক গুলোতে বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বন্দেশ রচনার কাজে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এমন রসোত্তীর্ণ বন্দেশ রচনা হয়েছে কিনা সন্দেহ। রচনা এবং তাতে যথার্থ সুরারোপ করে নিজে বিখ্যাত গায়ক হওয়ার সুবাদে তিনটি বিষয়ের যেন অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি বন্দেশগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণের তাগিদে তিনি প্রকাশ করে গেলেন ‘আরোহ-অবরোহ’ নামের সঙ্গীত গ্রন্থখানি। যা দেশের শাস্ত্রীর সঙ্গীত ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন। উস্তাদজী রচনা করেছেন চলচ্চিত্রোপযোগী বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সর্বপ্রথম এবং এখনো পর্যন্ত সঙ্গীত বিষয়ক একমাত্র নাটক ‘সুরের সন্ধানে’ যা পর পর বেশ কবার অভিনীত হয় দর্শককুলের অকুণ্ঠ প্রশংসার্জনের মাধ্যমে।
অবশেষে উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া চট্টগ্রামের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে নব যুগের সূচনা করে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর নিলেন ১৯৮৮ সালে আর্য্য সঙ্গীত সমিতি পরিচালিত সুরেন্দ্র সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ থেকে । অবসর যাপনকালে ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না উস্তাদজী। আবারো তালিম দেয়া শুরু করলেন তাঁর মোমিন রোড়স্থ বাসভবনে যা পরবর্তীতে ‘সুর সপ্তক সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ’ এ রূপ লাভ করে। সেখানেও গড়েছেন অসংখ্য শিষ্য-শিষ্যাকে। অবশেষে আজীবন সঙ্গীত সেবাব্রতী উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়ার জীবনাবসান হলো ৯ আগষ্ট ২০০১ সালে। মৃত্যুর বহু বছর পর উস্তাদজী মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হলেন। এই কর্ম প্রচেষ্টার সাথে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

তথ্য সূত্র: সুরেন্দ্র স্মৃতি বার্ষিকী, আর্য্য সংগীত সমিতি, চট্টগ্রাম
সুরেন্দ্রলাল স্মৃতি পূজা, আওয়ার অর্কেস্ট্রা, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
উস্তাদজির মাতা বিরলা বালা বড়ুয়া
ডা. কামাল এ খান
সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ সূচরীত চৌধূরী
সাংবাদিক ওবাইদুল হক
সঙ্গীতজ্ঞ গোপাল কৃষ্ণ চৌধূরী