রোকসানা বন্যা »
অহনা বাইরে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ। ট্রেন ছুটে চলেছে হুইসেল বাজিয়ে। অনেকবছর হলো ট্রেনে চড়া হয়নি। মনে হলো একটা তালেই চলছে। ছোটবেলা হলে ছড়া কাটতো মজা করে। অথচ আজ নির্বিকার। কী যেন হচ্ছে!
আবির অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অহনা এখনও বাইরে মুখ ঘুরিয়ে আছে। বাতাসে উড়ছে চুল।তারজন্য মুখটাও ঢাকা পড়ছে মাঝেমধ্যে।
আবির দেখছে মানুষটা রীতিমতো কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু হার মানছে না। নির্বিকার বসে আছে।
একটা সময়ে ট্রেন থামলো। গন্তব্যে নেমেই পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আবিরকে বলছিল, জানো আমি তোমার দেশকে দেখতে পেয়েছিলাম তোমার ভিতর, তার মাটিকে চিনতে পেরেছি তোমার মায়ায়। কী সুন্দর, মায়াময় তোমার এই গ্রাম!
পথেঘাটে তখন চড়া রোদ, দুপুর চুঁইয়ে বিকেল নামছে । হেমন্তের একটা ঘ্রাণ থাকে। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে হালকা শীতলতায় তা অনুভব করা যায়। পাকা ধানের একটা সুগন্ধি নাকে লাগছে।
এরই মধ্যে হাঁটছে দু’জন। একটু বিশ্রামের আশায় জুতসই একখানা কোণা বা দেয়াল খুঁজে বার করার লোভে চারপাশ দেখছে আবীর।
অহনার শিকারি চোখ।
এ-গলি সে-গলি হেঁটে ঠিক একের পর এক খুঁজে পেয়ে যাচ্ছে কোনও না কোনও মুখচোরা দরজা বা দেয়াল, আর আবিরকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে তাক করছে ক্যামেরা।
কোনও একটা শট মনমতো হয়ে গেলে হেসে উঠছে নেহাত বালিকাসুলভ ভঙ্গিতে। আর আবিরও সাধ্যমতো চেষ্টা করছে, তার নির্দেশ অনুযায়ী তাকাতে, দাঁড়াতে। পায়ে পায়ে পেরোচ্ছে তারা অলীক কোনও নিভৃতির সন্ধানে।
হাঁটতে হাঁটতে থামলো। দু‘জন একটা রিকশায় উঠে এগোলো। অহনা ঠিক বুঝতে পারছে না আর কতদূরে যেতে হবে। ক্লান্ত শরীর আর টেনে নেওয়ার ইচ্ছে করছে না। আবিরের দিকে তাকালো। হাত ইশারায় দেখিয়ে দিলো ওই বাঁকের পরেই।
একটা পুরোনো টিনের ছাউনিঘেরা বাড়ি দেখতে পেলো। উৎসুক মুখও দুু‘একটা দেখতে পাচ্ছে। বাড়িটার সামনে রিকশা থামে । ঘোমটাপরা এক নারী কাছে এসে ভিতরে নিয়ে খাটে বসায়। মাঝবয়েসী এক মহিলা হাসিমুখে কাছে এলো জল নিয়ে। ‘লেবুপানি খান, ভালো লাগবে আপনার’। আবির পরিচয় করিয়ে দেয়, আমার মা। অহনা চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
রাত নামলো। অহনা আবিরকে নিয়ে বের হলো উঠোনে। চাঁদের আলোয় উঠোন, মাঠ, বিল যেন উপচে পড়ছে। চারপাশে এতো আলো অথচ অহনার ভেতরেই শুধু অন্ধকার। অক্টোবরের এই রাতগুলো বড্ড বিষণ্ন। দাঁড়ালেই বোঝা যায় শীতের আগমন। বাতাসে কুয়াশার ঘ্রাণ, ভেসে আসে শিউলি বা ছাতিমের গন্ধ। ছাতিমের গন্ধ অহনার খুব প্রিয়। এই গাছের ফুল সবসময়ের জন্য আসেনা। অথচ দূরে থেকেও তাকে অনুভব করা যায়। এমন মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় ঘামছে অহনা। এই রাত কেমন যেন বিষণ্নতায় মোড়া।
আপনার গরম লাগছে। এটাই স্বাভাবিক এখানে । গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে না বললেই হয়। অহনা, এখানে আপনার কষ্ট হবে। আপনি বরঞ্চ ফিরে যান কাল। কাউকে কিছু বলতে হবে না। বলবেন শুধু ঘুরতে এসেছেন গ্রাম দেখবেন বলে। আবীর বকবক করেই যাচ্ছে।
চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অহনা। তারাগুলো কি গোনা যায়! গুনতে পারলেও গুলিয়ে ফেলছে সে। আকাশে আজ অনেক রঙের খেলা। কালো রঙই চোখে পড়ছে বেশি। চাঁদটা ওই রঙের মাঝে লুকোচুরি খেলছে।
আবির বলেই চলেছে, অহনা আপনি মোবাইল অন করেন। আপনি এখানে থাকতে পারবেন না। কষ্ট হবে। এই কষ্ট আমার দেখতে ভালো লাগবে না।
আচ্ছা আবির, অহনা বলে, ওই মেয়েটা কে? যে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলো। তারপর আর তার দেখা পাইনি। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে অথচ..। আবির মাথা নিচু করে আছে। চুপ থেকো না আবির! আমি কঠিন এক পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।
আবিরের নিশ্চুপতায় অহনার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। জল যেন থামছেই না।
একটু একা থাকতে চাইছি আবির। আবির শুধু বলে আমাকে ভুল বুঝবেন না । আপনাকে আমি ভালোবাসি। এটাই চরম সত্য ।এখানে কোনও কথা নেই আর!
অহনা জানিয়ে দিলো সকালের গাড়িতেই চলে যাবে। তোমার কোন ক্ষতি হবে না আবির।
খামখেয়ালি গলিঘুঁজির মধ্য মনখারাপ ওত পেতে লুকিয়ে আছে। ফেরার পথগুলো বড় একলা হয়ে গেলো।
এই নিভে আসা, ফুরিয়ে আসার মধ্য যে নিরুচ্চার অভিযোগ, তা আসলে স্পর্শজনিত অসুখ। যে অসুখের ওষুধ নেই। বরং ভাসমান কোনও চিরকুটে, বিচ্ছেদে, ফোনকলে বা কোন কফির টেবিলে লেপটে থেকেছে আদরের মতো। ‘খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’
মোবাইল অন করে অহনা। বাড়ি থেকে ফোন করছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। টেক্সট লিখে দিলো। গ্রামে এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছে। সকালে রওনা হবে। টেনশন করো না ।
ছুটির দিনের ইশকুল বাড়ির মতো মনটা ফাঁকা হয়ে গেলো। যাওয়া মানেই বিরহ। মাঝে মাঝে কার বা কিসের জন্য বিরহ…. সেটা নিজের কাছেও স্পষ্ট না।
‘তুমি তা জানো না কিছু-না জানিলে,আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে, যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’-পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
একটা পীত বর্ণের কভার। প্রচ্ছদপটে একটা বাঁশি আর বাঁশির সঙ্গে যুক্ত ছাতিমতলা, ময়ূরের পালকের ছবি । আর ভেতরের প্রতিটি পংক্তিতে তুমি বিরাজমান।