মাতারবাড়িতে ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প
২০২৪ সালের শুরুতেই উৎপাদিত হবে বিদ্যুৎ : প্রকল্প পরিচালক
ভূঁইয়া নজরুল, মহেশখালি (মাতারবাড়ি) থেকে ফিরে <<
মহেশখালীর মাতারবাড়িতে প্রায় ১৬০০ একর জায়গায় নির্মাণ হতে যাওয়া ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে আমি নিজেই রাস্তা হারিয়ে ফেলি। এই সপ্তাহে একদিক দিয়ে রাস্তা হলে অপর সপ্তাহে অন্য প্রান্ত দিয়ে পযতে হচ্ছে।’ প্রকল্প পরিচালকের এমন মন্তব্যে বোঝা যায় কতো দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবয়ব। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) বাস্তবায়ন করছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণযজ্ঞ দেখতে গত শনিবার প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গত বছর যে গেট দিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করা গেছে এখন আর সেই গেট নেই। সেটি বন্ধ করে পাশ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মিক্সচার প্ল্যান্ট। তার পাশেই নির্মাণকারী হুন্দাই প্রতিষ্ঠানের সাইট অফিস। তিন নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করে ১০০ গজ এগুলোই চার দিকে চারটি অস্থায়ী রাস্তা চলে গেছে। এদের কোনো রাস্তার প্রান্ত অসমাপ্ত আবার কোথাও বিভিন্ন ধরনের কাজ চলছে।
মাটিতে যেমন বহুমুখী রাস্তা নির্মিত হচ্ছে, তেমনি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মিত চ্যানেলেও নির্মাণ হচ্ছে জেটি। একটি জেটিতে জাহাজ ভেড়ানো অবস্থায় দেখা যায় এবং অপর আরেকটি জেটিও প্রস্তুত। নির্মাণ চলছে আরো দুটি জেটির। প্ল্যান্টের পূর্ব প্রান্তে নির্মিত হচ্ছে চার লেনের একটি রোড। এই রোডটি বদরখালি হয়ে চকরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। প্ল্যান্টের উত্তর প্রান্তের শেষ মাথায় কিছু তিনতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দূর থেকে একটি বহুতল কলোনীর মতো মনে হয়। সেই ভবনে থাকছে প্ল্যান্টে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। একসময় প্ল্যান্টের পাশের জেটিতে থাকা একটি জাহাজেই ছিল তাদের অফিস। প্রায় তিন বছর ধরে জাহাজে অফিস ও থাকা-খাওয়া সম্পাদনের পর এবার আবাসনের জন্য ভবন পেল। একইসাথে অফিস ভবন, আনসার ব্যারাক, শ্রমিক শেডসহ আরো কিছু স্থাপনা দক্ষিণ প্রান্তে নির্মিত হয়েছে। বাকি এলাকায় চলছে প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ।
কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইতিমধ্যে ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। যে গতিতে কাজ চলছে এতে জানুয়ারি ২০২৪ সালে আমরা উৎপাদন শুরু করতে পারবো।
বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০০ প্রকৌশলী-কর্মকর্তা এবং সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী বর্ষার আগেই আমরা পাইলিংয়ের কাজ শেষ করতে চাই। তাই ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে। এছাড়া গত ২৯ ডিসেম্বর আমাদের জেটিতে প্রথম জাহাজ ভেড়ার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে জাহাজে করে বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট আসছে। জাহাজ চলাচলের চ্যানেল চালু হওয়ায় নির্মাণ উপকরণ বা যেকোনো ধরনের পণ্য আনতে আর বিলম্ব হচ্ছে না। বছর জুড়ে এভাবে বিভিন্ন উপকরণ আসতে থাকবে এবং এগিয়ে যাবে প্ল্যান্টের নির্মাণ কাজ।
প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় ধাপের জন্য কি পর্যাপ্ত জায়গা রাখা আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য শুধু প্ল্যান্টের জায়গা হলেই চলবে। অন্যসব স্থাপনা প্রথম পর্যায়ে হয়ে যাবে। সেভাবেই জায়গায় প্ল্যান করে নির্মাণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
জানা যায়, দিনে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতিদিন আট হাজার মেট্রিকটন কয়লার প্রয়োজন হবে প্ল্যান্টে। সেই হিসেবে কয়লা রাখার জন্য বিশাল জায়গার পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি করে জাহাজ আসবে প্ল্যান্টে।
বিশ্বব্যাপী কয়লা বিদ্যুৎ নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তি থাকলেও এই প্রকল্পে পরিবেশ দূষণ কমাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হবে বলে কর্মকর্তারা জানান। প্ল্যান্টের চুল্লিটি ৯০০ ফুট উঁচুতে ধোঁয়া নির্গমন করবে এবং এতে বায়ু দূষণের মাত্রা কম হবে বলে তাদের দাবি। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পটি। প্রকল্পের অধীনে খনন করা হয়েছে একটি কৃত্রিম চ্যানেল। ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৮ মিটার গভীর এই চ্যানেল দিয়েই জাহাজ ভিড়ছে জেটিতে। আর এই চ্যানেলকে কেন্দ্র করেই এখানে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্র বন্দর।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটি চালু হলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ হবে। ২০২৪ সালে প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর আরো ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আগামীতে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে অসংখ্য শিল্প স্থাপনা গড়ে উঠছে। এছাড়া মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে ৩০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠছে বিশেষায়িত শিল্প প্রতিষ্ঠান, আনোয়ারায় হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, নির্মিত হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প শুরু হচ্ছে। আর এসব প্রকল্পে অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। শিল্পায়নের প্রসারে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে বিদ্যুতের বিকল্প নেই।