প্রকৃতি ও শিল্পের সংমিশ্রণ

স্মৃতি ও অনুভবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলার ঝুপড়ি। পেইন্টিং : দীপ্র বণিক

হুমাইরা তাজরিন »

উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহীদের স্বপ্নের গন্তব্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে অবস্থিত এটি। আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৬৬ সালে ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আয়তন ২১ শ’ একর (৮৫০ হেক্টর)। বিশালায়তন হলেও ইতোমধ্যে প্রায় ৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে।

এর শান্ত সুনিবিড় পরিবেশ যেমন পড়াশোনার জন্য বেশ উপযোগী তেমনি শৈল্পিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে এখানে বহু মনোরম জায়গা রয়েছে। ঋতুভেদে বৈচিত্র্যময় রূপ ধারণ করে এখানকার প্রকৃতি। হোক সেটা পাতাঝরার শীত,বর্ষার ঝুম ঝুম বৃষ্টি কিংবা বাসন্তী ফুলের বর্ণচ্ছটা। কোনো রূপেরই তুলনা নেই চবির।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন।

প্রধান সড়ক হতে স্মরণ চত্বর
শুরুতে বলতে হয়, এক নম্বর গেট হতে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কটির কথা। সারি সারি মেহগনি গাছের মাঝখানে কালচে পিচের সড়ক, সড়কের দু’পাশে সবুজ শস্যের ক্ষেত। শীতের শেষে শস্যের গা ঘেঁষে ভেসে আসা হাওয়ায় শুরু হয় পাতাঝড়া কিংবা পাতা ঝরে গিয়ে একসময় কালচে গায়ের মেহগনিতে দেখা দেয় কচি সবুজ পাতার সৌর্ন্দয। এ যেন প্রকৃতির অনন্য এক অভ্যর্থনা।

সড়ক পেরোলেই রেলওয়ে স্টেশন। চবিই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যার নিজস্ব শাটল ট্রেন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়তের অন্যতম বাহন এই শাটল। কতশত অভিযোগের পরও এই শাটলকে কেন্দ্র করে আবেগের অন্ত নেই শিক্ষার্থীদের। আসা যাওয়ার পথে শাটলের গা চাপড়ে গানের তাল না তুললে যেন যাত্রাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কেবল শাটলে নয়, বিকেল গড়ালেই স্টেশনেও বসে গানের আসর। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দেশ-বিদেশের নানা বিষয়ে তর্ক-বির্তক আলোচনা সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে স্টেশন চত্বর।

স্মরণচত্বর
এটিই মূলত চবির জিরোপয়েন্ট। এই মোড়টিকে ঘিরে স্থাপিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে ১৬জন বীর সন্তানের স্মরণে নির্মিত এই স্তম্ভটির স্থপতি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কাটা পাহাড়।

কাটাপাহাড়
যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গাটি ছিলো পাহাড়ি এলাকা। জনশ্রুতি আছে, অতীতে এখানে মগ রাজার রাজ্য ছিলো। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর যাতায়াতের সুবিধার জন্য এখানে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির প্রয়োজন পড়ে। সেই পাহাড় কেটে নির্মাণ করা রাস্তার নাম হয় ‘কাটাপাহাড়’। এই কাটা পাহাড় শিক্ষার্থীদের চলাচলের অন্যতম রাস্তা। নবীনদের এই রাস্তা পাড়ি দিতে বেশ কষ্টসাধ্য মনে হলেও সময় গড়ালে এটিই বরং শিক্ষার্থীদের প্রিয় রাস্তায় পরিণত হয়। চলার পথে দেখাও মেলে বানর, হরিণ, শুকর, বন মোরগ, সাপসহ বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণির। কাটাপাহাড় পেরোলেই ব্যবসাশিক্ষা অনুষদ।

শহিদ মিনার
চবির শহিদ মিনারটি নকশা করেছেন ‘অপরাজেয় বাংলার’ শিল্পী অধ্যাপক প্রয়াত সৈয়দ আব্দুলাহ খালিদ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পুষ্পাঞ্জলিতে ভরে ওঠে শহিদ মিনারটি। বিকেল গড়ালে এখানেও বসে জমজমাট আড্ডা। শীতের পিঠাপুলির উৎসবগুলোও হয় শহিদ মিনারকে কেন্দ্র করে।

বুদ্ধিজীবী চত্বর
শহিদ মিনারের ঠিক বিপরীত দিকে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভটি নকশা করেছেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী। কৌণিক এই স্মৃতিস্তম্ভকে ঘিরে রয়েছে বেষ্টনী। এই বেষ্টনীর ভিতরেই পাঠ্যসূচির বাইরের সকল বিষয়ে পাঠচক্র ও বিভিন্ন সংগঠনের সভা করেন। স্বাধীনতার মাসে এখানে বইমেলারও আয়োজন করা হয়।

জয় বাংলা ভাস্কর্য
শহিদ মিনার এবং বুদ্ধিজীবী চত্বরের মধ্যবর্তী মোড়ে রয়েছে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্য। লাইভ কাস্টিং মেথডে ধূসর আস্তরণে মার্বেল ডাস্ট ব্যবহার করে তৈরি এই ভাস্কর্যটি। চারুকলা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহানের সৃষ্টি এই ভাস্কর্যটি। অধিষ্ঠিত ৩জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে নিচের বেদিতে ২০জন মানব অবয়ব রয়েছে ভাস্কর্যটিতে। মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্রের মুখে রয়েছে পাখির অবয়ব । যেটি যুদ্ধ এবং ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করা স্বাধীনতাকে প্রতীকায়িত করছে। ভাস্কর্য পেরোলেই একপাশে প্রশাসনিক ভবন অন্য পাশে প্রকৌশল অনুষদ। অনুষদ পেরোলেই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। গ্রন্থগারের পরে রয়েছে কেন্দ্রীয় জাদুঘর। জাদুঘরের বিপরীতে রয়েছে কলা অনুষদ এবং স্বাধীনতা স্মৃতি¯তম্ভ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীণতা স্তম্ভ।

স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ
এটি নকশা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক সৈয়দ সাইদুল কবীর। শিল্পী মর্তুজা বশীরের একক প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা স্মৃতি ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়।

কলার ঝুপড়ি
আহামরি কিছু নয়, টিনের চালের সাধারণ বেড়ার দোকান। তবে দিনরাত শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় রমরমা থাকে এই ঝুপড়িটি। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা ক্লাস শেষে এখানে গানে আড্ডায় মাতেন শিক্ষার্থীরা। এই আড্ডায় যে মধুর আত্মিক সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে সময় গড়ালে শিক্ষাজীবন শেষে তাদেরই বিদায় জানাতে হয়। প্রাক্তনেরা তাই ক্যাম্পাসে ফিরেই ঝুপড়ির স্মৃতিতে হন কাতর।

চালন্দা গিরিপথ
কলার ঝুপড়ি পেরোলেই সমতল নেমে আসে একটি বয়ে চলা ঝিরিতে। সেই ঝিরি ধরে এগোলেই মেলে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার জলধারা। যেখানে পাহাড় আর সমতলের মাটি জমে দীর্ঘদিনে রূপ নিয়েছে পাথরে।যা দু পাশ থেকে চেপে সরু করেছে গিরিপথটিকে। এই মনোরম রোমাঞ্চকর গিরিপথটি প্রত্যক্ষ করতে প্রথম বর্ষেই দলবেঁধে আসেন শিক্ষার্থীরা।

ঝর্না
গিরিপথের গোঁড়ায় এবং কলা অনুষদের পেছনে এই ঝর্নাটি অবস্থিত। বর্ষায় বেশ জল থৈ থৈ করে এখানে। তবে দেখতে বেশ নয়নাভিরাম হলেও বেশ ঝুঁকি রয়েছে এই ঝর্নাটিতে। পা পিছলে পড়ে বা গোসল করতে নেমে ডুবে প্রায় প্রতি বছরই এখানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

সেন্ট্রাল ফিল্ড
চবির অন্যতম খোলামেলা প্রাঙ্গন এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক বিজ্ঞান বিভাগ, জিনেশিয়ামের পাশে অবস্থিত এটি। বার্ষিক ক্রীড়া ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট এবং ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয়। যেকোনো খেলাধুলা অনুশীলনের জন্য শিক্ষার্থীরা এখানে ভিড় করেন। সাইক্লিং, ড্রাইভিং ইত্যাদিরও এই বিশাল মাঠটিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়। বিকেলবেলা বন্ধু-বান্ধব পরিবার-পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে অনেকেই এখানে আসেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশার মোড় থেকে দোলা সরণী যাওয়ার রাস্তা।

হতাশার মোড়
শহিদ মিনার পার হয়ে প্রীতিলতা হলের পর এই মোড়টি অবস্থিত। প্রেমিকাহীন দুষ্টু তরুণেরা লেডিস হলের সামনে হাহাকার প্রকাশে এর নামকরণ করেন ‘হতাশার মোড়’।

বোটানির পুকুর পাড়
হতাশার মোড় পার হয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন যাওয়ার পথে এই পুকুরটি অবস্থিত। নারিকেল এবং ইউক্যালিপ্টাসে ঘেরা এই পুকুরটি বেশ নয়নাভিরাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ চড়–ইভাতি, শ্রেণি উৎসব এই পুকুরের পাড়েই আয়োজন করা হয়। তাছাড়া পাশ্ববর্তী চাচার দোকানে বসে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে এখানে পরিবেশ পায় নৈর্সগিক মাত্রা।

ফরেস্ট্রি রোড
এই সড়কটি ধরেই বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে যেতে হয়। এক পাশে পাহাড় আর অন্যপাশে ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। ঘন ছায়ায় হাঁটতে ভর করে না ক্লান্তি।

বর্ষায় – ঝড়ে ঝরেপড়া হলুদ পাতাতে স্বর্গীয় সড়কের রূপ নেয় এটি। এগোলেই ইন্সটিটিউট এবং মাস্টার দা সূর্য সেন হল। সূর্য সেন হলের ছাত্রী নিবাসের পাশ দিয়ে এগোলে মেলে আলো ছায়ার বাঁশ বাগান। যেখানে মাঁচায় বসে উপভোগ করা যায় আশপাশের সৌন্দর্য।

বায়োলজির পুকুরপাড়
জীববিজ্ঞান অনুষদের পাশে থাকা এই পুকুরটিতে রয়েছে সুন্দর একটি ছাউনিপড়া ঘাট। ছাত্ররা মাঝে-সাঝে হৈ হুল্লোড় করে নেমে পড়েন গোসলে। ছোটখাটো খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও চলে এই ঘাটে বসে। এই ঘাট পেরিয়ে এগোলেই পাহাড়ের বুক চিরে থাকা সরু পথ। সেখান থেকেই মিলবে গুটিখোলা এলাকার । যেখানে পুকুর, পাহাড়, মাঠ, খালের সংমিশ্রণে অবারিত এলাকা। কোথাও লিচুর বাগান, কোথাও পেয়ারার আবার কোথাও বা আম কিংবা কাঁঠালের বাগান।

পেইন্টিং দীপ্র বণিক