প্রকৃতির সবুজ পর্দায় ঢেকে যায় ‘অসুন্দর’

হুমাইরা তাজরিন »

প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে সকল সৌন্দর্যই ফিকে। এর চেয়ে বড়ো শিল্প যেন আর নেই। শৈল্পিক প্রয়োজনে বারবার প্রকৃতির দারস্থ হয়েছে মানুষ। নগরের ভবনগুলোর সৌন্দর্য বাড়াতে ‘কার্টেন ক্রিপার’ নামের একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। ভবনের ভেতরকার নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে এই সুবিধাজনক নান্দনিক উদ্ভিদটি। নগরীর বিভিন্ন ভবনে এমন উদ্ভিদের ব্যবহারে ঢেকে যাচ্ছে ‘অসুন্দর’।

কার্টেন ক্রিপার বা টার্মোনিয়া এলিপ্টিকা। বৈজ্ঞানিক নাম ভার্নোনিয়া এলিপ্টিকা। ভার্নোনিয়া গণের এই উদ্ভিদটি এস্টারাসিয়া (সূর্যমুখি, গাঁদা ও ডেইজি) পরিবার ভুক্ত। চীন থেকে মালয় পর্যন্ত এই প্রজাতিটির পরিসর। আদি নিবাস কম্বোডিয়া, দক্ষিণ-মধ্য চীন, লাওস, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, কুইন্সল্যান্ড ও বাংলাদেশ। তবে অস্ট্রেলিয়া এবং তাইওয়ানেও এটির বিস্তৃতি রয়েছে।

পরাশ্রয়ী এই উদ্ভিদটি উর্বর মাটিতে জন্ম নেয়। অবলম্বন করে ওঠার কারণে এর লতা ঝুলে পড়ে এর নান্দনিকতা বৃদ্ধি করে।

শীতের শেষভাগ থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এই উদ্ভিদে ফুল ফোটে। তবে ফুলগুলো আকারে ছোট হয়ে থাকে। থোকা থোকা এসব ফুলগুলো সচরাচর সাদা রঙের হয়ে থাকে। এর পাতা হালকা এবং গাঢ় সবুজ হয়ে থাকে। সরু পাতাগুলো ১-২ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। সরু লতার দুই পাশে পাতাগুলো সজ্জি¦ত থাকে। এই উদ্ভিদটিকে বিশেষ যতেœর প্রয়োজন পড়েনা।

এর স্পর্শে ভবনে পোকামাকড়ের প্রবেশও বাধা পায়। উদ্ভিদটি প্রয়োজন অনুযায়ী ছাঁটাই করা যায়। ছাঁটাইয়ের ফলে লতাগুলো দেড় ফুটের তুলনায় বেশ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। পরোক্ষ সূর্যালোকের (২১ ডিগ্রি থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) উপস্থিতিতে এর বর্ধন ঘটে। এই বৃক্ষের পরিচর্যার জন্য মাটি ও পানিরও বিশেষ প্রয়োজন পড়েনা। বর্ষাকাল এবং শীতকালে পানির পরিমাণ সচারাচরের তুলনায় কম রাখতে হয়।

তবে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, এটি একটি বিরল এবং অস্বাভাবিক প্রজাতির উদ্ভিদ। এর অনন্য গড়ন বৈশিষ্ট্যেও কারণ একে ‘মেডুসার মাথা ’ বা ‘অক্টোপাস উদ্ভিদ’ও বলা হয়।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের আসকার দিঘীরপাড়ের ইস্পাহানি বাংলো, প্রবর্ত্তক মোড় সংলগ্ন ইকুইটি তিলোত্তমা হাউজিং সোসাইটি কর্তৃক নির্মিত ভবন , দক্ষিণ খুলসীর নাহার এগ্রো , ব্যাটারী গলিসহ বিভিন্ন এলাকার বহুতল ভবনগুলোতে কার্টেন ক্রিপারের দেখা মিলছে।

প্রবর্ত্তক মোড় সংলগ্ন ইকুইটি তিলোত্তমা হাউজিং সোসাইটির প্রবেশমুখে কার্টেন ক্রিপার লাগিয়েছেন ইকুইটি প্রর্পাটিজ লিমিটেডের কাস্টমার সার্ভিস ডির্পাটমেন্টের এসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার আমাতুল খায়ের সেতু। তিনি বলেন,‘ এই গাছটির একটি ভালো দিক হলো, খুব বেশি যতœ নিতে হয়না। অল্প পাহাড়ি মাটি যা নার্সারিতে পাওয়া যায় আর পানি দিয়ে কাঠিযুক্ত করে লাগালেই বেশ বেড়ে ওঠে। আমাদের সবসময় তো যতœ নেওয়া সম্ভব হয়না। কিন্তু এই গাছে পানি, মাটি দেওয়ার তাড়া থাকেনা। লতা বেশ বেড়ে উঠলে কেবল ছেঁটে দিলে আবারও বেড়ে উঠে। আমাকে একজন আর্কিটেক্ট বলেছিলেন সোহাগী লতা বা যেটাকে সচরাচর সিঙ্গাপুরি ডেইজি বলে সেটা লাগাতে। কিন্তু সেটা দেয়াল বা যেখানে লাগানো হয় সে জায়গাটা নষ্ট করে ফেলে। আবার চাইলে সহজে উপড়ে ফেলা যায়না। আর এই গাছগুলো পর্দার মতো হওয়ায় ভবনের পাশের যে নালাটা আছে সেটি আড়াল করার কথা মাথায় রেখেও এই গাছটি রোপণ করি। তাই অন্যান্য গাছের তুলনায় কার্টেন ক্রিপার আমার কাছে সুন্দর এবং বেশ সুবিধাজনক মনে হয়’।

তবে এত শত সুবিধার পরও এই বৃক্ষটি কিছুটা স্বার্থপর প্রকৃতির। উদ্ভিদটি সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ড. শেখ বখতিয়ার উদ্দীনের সঙ্গে সুপ্রভাতের কথা হলে এ বিষয়টি স্পর্ষ্ট হয়ে ওঠে । তিনি বলেন,‘ টারমোনিয়া এলিপ্টিকা যে সব অঞ্চলে স্থানীয় নয় সেখানে এটি আক্রমণাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধরণের উদ্ভিদ স্থানীয় গাছপালার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে। অর্থাৎ যেখানে এই গাছ জন্ম নেয় সেখানে অন্যান্য গাছ টিকে নাও থাকতে পারে। এটি ক্ষতিকর হতে পারে গবাদি পশুর জন্যেও। তাই এর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেই একে রোপণ করা উচিত। এবং এই উদ্ভিদের নিত্য নতুন তথ্য সম্পর্কেও অবগত থাকতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।’