প্রকাশনাশিল্পের দুর্দিন

dav

কাগজের চড়া দাম

শিক্ষা উপকরণের দামও বাড়তি

রাজিব শর্মা »

কয়েক মাসের ব্যবধানে কাগজের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতরা। বিক্রি কমে যাওয়া ও মূলধন সংকটে অনেক ক্ষুদ্রব্যবসায়ী ইতিমধ্যে কাগজ বিক্রি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর তাতে ধস নামছে প্রকাশনা শিল্পে।

সংশ্লিষ্ট কাগজ-মুদ্রণশিল্প ব্যবসায়ী ও প্রকাশনাশিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আন্দরকিল্লা প্রেস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, ‘৬১ গ্রাম মানের কাগজের দাম ছিল ১৫০০ তা এখন ২৭০০ টাকা। ২০০ টাকার কালারপ্রিন্টের কাগজ এখন ৮০০-৯০০, ১০০ গ্রাম মানের অফসেট যেখানে ২০০০ হাজার টাকায় মিলতো, তা এখন ৪ হাজার ৩০০’র বেশি। এর মধ্যে ছাপাখানা কর্মীর বেতন, রুম ভাড়া, যান্ত্রিক খরচ, বিদ্যুৎ বিল, জ্বালানি বিলসহ প্রতি ব্যবসায়ী মাসে গড়ে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসানে থাকেন। এতে অনেক ব্যবসায়ী মুদ্রণব্যবসা ছেড়েছেন। তাছাড়া বর্তমানে কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ কমে গেছে। অনেক কর্মী এখন এ পেশা ছেড়ে সিএনজি ট্যাক্সি চালায়, ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রি করে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আমরা কাগজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বিষয়টি জানতাম না। আমাদের কাছে কাগজের বাজার তদারকির নির্দেশনা আসেনি। বিষয়টি নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব।’

সরেজমিনে নগরের আন্দরকিল্লা, গোলাম রসুল মার্কেট, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন কাগজের বাজার ঘুরে দেখা যায়, নিউজপ্রিন্টের কাগজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ দিস্তার এক রিম ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায়। যা ছয় মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকার কমে। আর ২১ বাই ৩৫ সাইজের সাদা কাগজ ২০৮০ থেকে ২১০০ টাকায়, ২৩ বাই ৩৬ সাইজের কাগজ ২৪০০ থেকে ২৪৮০ টাকা। আর ২১ বাই ৩৬ সাইজের কাগজ ১৯২০ থেকে ১৯৪০ টাকা। এছাড়া তিন মাস আগে এ ফোর সাইজের ৫০০ শিটের অফসেট কাগজ বিক্রি হয়েছিল ২৮০ থেকে ২৯০ টাকা, এখন তা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকার উপরে। কাগজের দাম গত ছয় মাসে ৭০ শতাংশের বেশি বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির তথ্যমতে, গত এক বছর আগে সাদা কাগজ দিস্তা প্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল তা বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে বছরের ব্যবধানে সাদা কাগজের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশের বেশি।

কাগজের বাজার দাম বাড়ায় পরোক্ষভাবে চাপে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। কারণ কাগজের বাড়তি দামের কারণে ছাপা বইয়ের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।

আন্দরকিল্লা এলাকার ক্রিয়েটিভ পেপার্স অ্যান্ড স্টেশনারি দোকানের ম্যানেজার মো. পিয়াস বলেন, ‘আগে আমরা কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ কাগজ কিনতে পারতাম, এখন তা পারছি না। যে মানের কাগজের দাম ১৬০, তা এখন ৩৪০ টাকা কিনতে হয়। অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।’
ফ্রেন্ডস স্টেশনারির সেলস ম্যানেজার মো. জুবায়ের বলেন, ‘আগে যেসব অভিভাবক এক সঙ্গে দুই রিম কিনতেন এখন তারা এক রিমও কিনছেন না। নিউজপ্রিন্ট আগে দিস্তা প্রতি ৭-৮ টাকা বিক্রি করতাম, তা এখন তিনগুণ বেড়ে ২০ টাকা হয়েছে। বলা যায় ২৫ টাকার নিচে কাগজ নেই। কাগজের বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করছে, তা তদারকি করা প্রয়োজন।’

মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিক প্রিয়া সুশীল বলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ার প্রভাবটি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেশি পড়ছে। শিক্ষা উপকরণের দামের বিষয়টি প্রশাসনের নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।’
চট্টগ্রাম কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জয়া শর্মা বলেন, ‘শুধু কাগজ নয়, কলম, পেনসিল, জ্যামিতি বক্স, অফসেট পেপারসহ নানা শিক্ষা উপকরণের দাম চড়া।’

আগ্রহ হারাচ্ছে পাঠক

কাগজের দামবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পাঠ্যপুস্তকসহ সহযোগী নানা বই, উপন্যাস ও গল্পের বইয়ের দামও। এতে বই কিনে পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন পাঠক।

বাতিঘরে বই কিনতে আসা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘নিজের সামর্থ্যের মধ্যে না হওয়াতেই বই কিনতে পারিনি। তাছাড়া আগে যে বই ২০০-২৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত তা এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।’
আন্দরকিল্লার বই ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর পাঠকেরা অনেক বই কম কিনছেন। প্রায় ৭০ শতাংশের ওপরে কমেছে এ হার।’

চিন্তিত প্রকাশকেরা

কাগজ ও প্রকাশনা ব্যবসার উপকরণের দাম বাড়ায় ক্রেতার সংখ্যা কমেছে। ফলে বই প্রকাশ করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন প্রকাশকেরা।

বলাকা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আগে আমরা বই প্রকাশ করতাম ৭০ থেকে ৮০টি। এখন প্রকাশনাশিল্পের সাথে জড়িত সকল কিছু চড়া দামের কারণে লেখকেরা আর বই প্রকাশে আগ্রহী হচ্ছেন না। তাছাড়া আগে যে বইয়ের দাম নির্ধারণ করা হতো ১০০ টাকা, তা এখন দেড়গুণ বাড়তি নিয়ে নির্ধারণ করতে হচ্ছে ২৫০ টাকা।

আবির প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী নূরুল আবছার বলেন, ‘আগে আমরা যে বই ২৫ হাজার টাকায় বের করতে পারতাম, তা এখন ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়ও পারি না।’
সংকটে মুদ্রণশিল্প ব্যবসায়ীরা

কাগজের দাম বাড়াতে অন্যান্য বছরের তুলনায় ক্রেতাদের অর্ডার অনেক কমেছে বলে জানান প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। তাঁদের মতে, চলতি বছর ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, প্যাড, নোটবুক ছাপানো কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। এমনকি এক বছরের ব্যবধানে অন্তত ১৫ থেকে ২০ প্রতিষ্ঠান ব্যবসা ছেড়েছে বলে জানান তারা।
আন্দরকিল্লার এসবি প্রিন্টার্সের মালিক মো. নাঈম উদ্দিন বলেন, ‘অন্যান্য বছর এ সময় যেভাবে অর্ডার থাকতো, এখন তেমন নেই। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ কমে গেছে।’