ইউরোপে চাকরির খোঁজে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও বাংলাদেশিদের যাওয়ার বিরাম নেই। মরুভূমিতে প্রাণ হারানো কিংবা ভূমধ্যসাগরের সলিল সমাধি, এখন পূর্ব ইউরোপের জঙ্গলে আটকে পড়াÑকোন ভয়ংকর পরিস্থিতিই বাংলাদেশিদের অবৈধ পথে যাত্রা থেকে নিবৃত্ত করতে পারছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গত ৫ বছরে প্রাণ গেছে ১৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির। কয়েকদিন আগে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে বাংলাদেশিসহ ২২জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে কয়েকজন।
ইউরোপে পাচারের এখন নতুন রুট হয়েছে মধ্য ইউরোপের বসনিয়াÑহার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়া। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এপি খবর দিয়েছে, এই দুটি দেশের জঙ্গলে প্রচ- ঠা-ার মধ্যে বাংলাদেশিসহ ৬ শতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশী আটকে পড়েছে। মানবপাচারকারীচক্র আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলিতে এসব ভাগ্যান্বেষী মানুষদের পাঠায়। বছর খানেক ধরে এই পথ মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অভিবাসীদের এই ধরণের অভিবাসন প্রচেষ্টা খুবই বিপদসংকুল; মরুভূমি, পাহাড়, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র পথ পাড়ি দিতে অনেকে মারা যান। এরপরও অভিবাসীদের ¯্রােত আটকানো যাচ্ছে না। মৃত্যু, আটক, অবরুদ্ধ শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন বাংলাদেশিদের ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্লোভেনিয়ার একটি বার্তা সংস্থা জানায়, গত রোববার দেশটির কর্তৃপক্ষ ১৪৪ জনকে আটক করেছে যাদের অধিকাংশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের।
গত ৮ মাসে ১০ হাজারেরও বেশি অভিবাসীকে আটক করেছে অবৈধভাবে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপরাধে। বসনিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বসনিয়ার জঙ্গলে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের খবর জানাতে বসনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছে। জঙ্গলে আটকেপড়া বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের উদ্ধার করে মানবতার স্বার্থে তাদের আশ্রয় শিবিরে নিতে বসনিয়া ও স্লোভেনিয়ার সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে, সেই সাথে আমাদের দূতাবাস বাংলাদেশিদের অবস্থান নিরাপদ করতে সক্রিয় ভূমিকা নেবে বলে আমরা আশা করি।
শুধু ইউরোপ নয়, ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মালয়েশিয়ায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ায় সারাবিশ্বে আলোড়ন ওঠে, হতভাগ্যদের অধিকাংশই বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় করা হতো, নতুবা মেরে ফেলা হতো। বাংলাদেশে সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্র আন্তর্জাতিক কারবারিদের যোগসাজশে এই অপকর্মে লিপ্ত। বারবার বাংলাদেশিদের মর্মান্তিক মৃত্যু সত্ত্বেও মানবপাচার বন্ধ হয়নি বরং নিত্যনতুন রুট এবং ফন্দি ফিকির করে এই অবৈধ ব্যবসা চালানো হচ্ছে। নারী পাচারও এই সাথে চলছে নানা কায়দায়। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কিছু তৎপরতা দেখায়। মানবপাচার চক্রের দুই একজন ধরাও পড়ে কিন্তু মূল হোতারা আড়ালেই থেকে যায়।
এ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশ গমন প্রতিরোধে পারিবারিকভাবে সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। নারীপাচার চক্র সম্পর্কে পরিবার ও এলাকার লোকজনদের সতর্ক হতে হবে। বৈধভাবে সরকার বিদেশে যাওয়ার কথা বলে আসছে, তবুও কিছু উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি মানবপাচার চক্রের কবলে পড়ে ঝুঁকি নিয়ে, অধিক টাকা খরচ করে বিদেশে যাচ্ছেন। এই টাকা দিয়ে দেশেই স্ব-কর্মসংস্থান সম্ভব। সরকার মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর হবে, এই মানবপাচারকারীরা সমাজ ও দেশের শত্রু। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা পূর্ব ইউরোপের অরণ্যে আটকেপড়া অভিবাসীদের উদ্ধারে সক্রিয় হবে বলে আমরা আশা করি।
মতামত সম্পাদকীয়