মান্নান নূর »
প্রকৃতি আমাদেরকে ঢেলে দিয়েছে তার সৌন্দর্য আর লাবণ্য। একটুও কৃপণ নয়। ধনী-গরীব সকলেই সমান।
পুতুল বিকেলে বসে বসে বৌলাছড়া চা বাগানের সৌন্দর্য দেখছে। প্রতিদিনের রুটিন। সবুজে ঘেরা পাহাড় সত্যিই অসাধারণ। কিন্তু এ অসাধারণ তার ভালো লাগে না। বাগানের পাখিদের খুশ-গল্পও। পুতুল এ সুন্দর দিয়ে করবেটা কী? সুন্দর তো আর খাওয়া যায় না! তবু সে এ বয়সে ভালোই বোঝে। কিছুটা হলেও কষ্টটা ভাগ করে নেয় প্রকৃতি। কিছুটা হলেও মন ভালো করে দেয় এ-আকাশ, এ-আলো। তার সমস্ত মনের অভিযোগ জানায় সে নিঃসঙ্গ কোলাহলকে।
পুতুল সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো ক্ষুধার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। থালার এক প্রান্তে দু‘মুঠো পান্তা ভাত। প্রতিদিনের রুটিন। ভালো লাগে না। না লাগলেও কিছুই করার নেই। জন্মের পর থেকেই তা দেখে আসছে। কোনো কোনোদিন একবেলা শুধু খেতে পায়। প্রথম প্রথম কাঁদলেও এখন আর কাঁদে না। চোখে পানি আছে, কিন্তু মন খারাপের গল্প নেই। যার জীবনটাই মন খারাপের তার আবার কান্না কিসের?
লবণ দিয়ে পান্তা খেতে খেতে বললো, ও-মা, তুমি না কইছলা মুরগির মাংস খাওয়াইবা? কই? মাস তো পার অইলো! শিউলি কন্দ মেয়ের দিকে চেয়ে শীতল চোখে বললো, মাস-তো না-রে মা, আমারই তো মনে নেই কবে মাংস খাইছি। না গরুর, না খাশির, না ব্রয়লার! কেমনে কিনুম, যে দাম মা-রে, সবুর কর। কিনবো একদিন। এই একদিন বলে কতোদিন যে গেলো তাদের আর মাংস খাওয়া হয় না।
মাসের বেতনটা পাইয়া লইরে মা, -”কয়দিন লাগবো বেতন পাইতে?” পুতুল জিজ্ঞেস করে। এইতো মাস শেষ অয় অয়। পুতুল মাসের হিসাব এখনো শেখেনি। তারিখ বোঝে না। স্কুলে যাওয়ার বয়স হইলেও স্কুল কই? চা বাগানে প্রাইমারি স্কুল নেই। তারা বংশ পরম্পরায় মুর্খই থেকে যায়। সে শুধু জানে বড়দের মুখে শুনেছে বাচ্চারা স্কুলে পড়ে আনন্দ করে। এ গল্প শুনে পুতুলের মন ভারী খারাপ হয়। সেও যদি স্কুলে পড়তে পারতো, খেলতে পারতো! পুতুলের মতো হাজারো চা শ্রমিকদের ছেলে মেয়েরা যুগের পর যুগ শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে। তাদের বড় হওয়া মানে চা শ্রমিক। এটাই তাদের ভাগ্য।
শিউলি কন্দ স্বামীর হাতে মাসের বেতন দিয়ে বললো, এখন কী করবা? পুরিডা মাংস খাইতে কইছে। আর কত ভুলাইয়া রাখমু। দেহছে কিছু করা যায়নি।
লিটন বড়বড় চোখ করে তাকায়। পুতুল খেলছে। এ বয়সে তার কোনো বায়না নেই। এতটুকুন বয়সেই সে বুঝে গেছে বাবা মায়ের কষ্ট। মজা খাইবার চাহিদা নাই। শুধু দু‘মুঠো ভাত পেলেই সে খুশি। চা বাগানে ১৪৫ টাকা রোজে চাকরি করে ব্রয়লার মুরগি কেনাটা কত কঠিন সে কি বুঝবে? কেজি ২৩০ টাকা ব্রয়লার। এক দিনের রোজ দিয়াও এক কেজি মাংস জোটে না। লিটনের চোখে জল। কতদিন পর সে কাঁদলো। না-পুতুলকে ঠকানো যাবে না। পুতুল একটু হাসুক।
শিউলি পুতুলকে খেতে ডাকছে। পুতুল হাত ধুয়ে খেতে বসেছে। ঘরে মাংসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে। সে খুশিতে লাফাচ্ছে। বললো, মা- সত্যিই মাংস রানছ! মা পাতে দু‘টো মাংসের টুকরো রেখে বললো, খাও, খেয়ে দেখ।
পুতুল নির্মোহ শান্তভাবে মাংস খেতে লাগলো। লিটন আর শিউলি দু‘চোখ ভরে পুতুলের তৃপ্তিবোধ দেখছে। একে অপরের দিকে চেয়ে হাসলো। পরক্ষণই দু‘জনের মুখ মলিন হয়ে গেলো। সামনের পুরো মাস চলবে কী করে?