কক্সবাজার
নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে প্রচারাভিযান
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে ১২ হাজারের বেশি পরিবার। কক্সবাজার ‘পাহাড় ধস প্রবণ’ জেলা হওয়ায় প্রতিবছর পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ে। গত বছরও (২০২২ সালে) জেলায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ঝুঁকিপূর্ণ বসতির কারণে এবারো মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন পাহাড় বসবাসকারীরা।
কক্সবাজারে শুরু হয়েছে ভারি বর্ষণ। তাই পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করেছে এবং সেই সাথে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
২০ জুন দুপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) জাহিদ ইকবালের নেতৃত্বে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি পাহাড়ি এলাকায় প্রচারাভিযান চালানো হয়। তিনি জানান, কক্সবাজার শহরের অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেই সাথে যারা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসবে না, তাদের পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করা হবে বলে জানানো হয়।
কক্সাবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র হেলাল উদ্দিন কবির জানান, নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসার জন্য কক্সবাজার শহরে ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি পরিবারের সদস্যদের আশ্রয় দেয়া হবে এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছে কক্সবাজার পৌরসভা। পাহাড় দখল ও পাহাড়ে বসবাস ঠেকাতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি এ জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, পৌর শহরের ১২টি ওয়ার্ডের যে সব এলাকায় পাহাড় ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে সেখানে স্ব স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ঝুঁিকপূর্ণ পরিবারের জানমাল রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, কক্সবাজারে বড় সমস্যা হচ্ছে পাহাড় কাটা ও পাহাড় দখল। আর বৃষ্টি হলেই এসব পাহাড় ভয়াবহ রূপ নেয়। তাই ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার জন্য ঘরে ঘরে প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে। যারা নিজ দায়িত্বে পাহাড় থেকে সরে আসবেন না, তাদের সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হবে।
এদিকে জানা যায়, উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে কক্সবাজার জেলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ১২ হাজারের বেশি পরিবার পাহাড়ের তলদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার পরিবার।
কক্সবাজার শহর ও শহরতলিতে প্রায় ৭ হাজার পরিবার ও জেলায় বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় আরো ৫ হাজার পরিবার পাহাড়ে ঝূঁকি নিয়ে বসবাস করছে। পাহাড়ে হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থাকার কারণে পাহাড় ধসের শংকা রয়েছে। কক্সবাজার শহর ও শহরতলির লাইট হাউজ, সৈকত পাড়া, সার্কিট হাউস সংলগ্ন মোহাজের পাড়া, দক্ষিণ ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, বৈদ্যঘোনা, মধ্যম ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলি, কলাতলী আদর্শগ্রাম, ঝরিঝরিকুয়া, সদর উপজেলা অফিস সংলগ্ন, লিংকরোড পাহাড়ি এলাকায়।
অন্যদিকে সদর উপজেলার পিএমখালী, খুরুস্কুল, মহেশখালী, রামু, টেকনাফ ও উখিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা গত তিন বছরে দ্বিগুণ বেড়েছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ বনবিভাগের আওতাধীন বনভূমিতে ৩,৫২৫ পরিবার অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। অন্যদিকে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৮শ পরিবারের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি পরিবারের সংখ্যা ২৫টি।
শহরের লাইট হাউজ পাহাড়ের বসবাসকারি সাইফুল ইসলাম জানান, শহরের বিভিন্ন এলাকায় দিনমজুরি করে জীবন চলে তাদের সংসার। রাতে মাথা গোজানোর জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে পাহাড়ে বসবাস করতে হচ্ছে। কিন্তু ভারি বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুনাইদ জানান, পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে কক্সবাজার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গত ২০২১ সালে জেলায় ১৪ জনের পাহাড়ধসে মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বড় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০১০ সালে। ২০১০ সালের ১৫ জুন একদিনে হিমছড়িতের ৬ জন সেনা সদস্যসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে ৫৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। প্রতিবছর এভাবে পাহাড় ধসে কক্সবাজারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। প্রতিবছর বিপদ আসন্ন হলেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠে। এর পর কোন খবর থাকে না। তবে আশার কথা, ৪ বছর আগে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারিদের তালিকা এবং সরানোর কমিটি গঠিত হয়। তখন বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বসতির তালিকা করা হয় এবং অসংখ্য পরিবারকে তখন নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর কোন তৎপরতা না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা বেড়ে গেছে। একদিকে পাহাড়ধসে মৃত্যু যেমন হচ্ছে অন্যদিকে পাহাড়ে বসবাসের কারণে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি হিসেবে যাই থাকুক বর্তমানে জেলায় ১২ হাজারের বেশি পরিবার পাহাড় পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। এদের দ্রুত সরিয়ে নেয়া না হলে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো পাহাড়ধসে মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। কক্সবাজারে প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আর এই মৃত্যুর দায়ভার বর্তাবে দায়িত্বশীলদের উপর।’