পানির বোতল যেভাবে ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাকের আধার হয়ে উঠতে পারে

সুপ্রভাত ডেস্ক  »

আমাদের নিয়মিত বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। চিকিৎসকরা সব সময়ই এ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর এ পরামর্শকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন তারকারা। তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রঙিন ধাতব বোতল হাতে ছবি পোস্ট করেন। এসব রঙিন বোতল এখন ফ্যাশনের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। তাই পানি পান এখন শুধু সুস্থতার জন্য নয়, মসৃণ ত্বক, হজমশক্তি বৃদ্ধি ও দেহের মাংসপেশি আরও সচল রাখতে প্রচুর পানি পান করা প্রয়োজন।

তবে পানি বেশি পান করার পরামর্শের পাশাপাশি পরিবেশের স্বাস্থ্যের জন্য প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সতর্ক করা হয়। স্পেনে প্রতিদিন ৫৫ মিলিয়ন বোতল বিক্রি হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ বোতলই পুনর্ব্যবহার করা যায়। এর সহজ সমাধান হলো পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতল। যদিও এটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প, তবে সঠিকভাবে পরিষ্কার না করলে এই বোতলগুলোতে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস জমে যেতে পারে এবং দুর্ভাগ্যবশত, এটি স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

সম্প্রতি পরিচালিত একাধিক গবেষণায় পুনঃব্যবহারযোগ্য পানির বোতলে জীবাণুর জমা হওয়ার বিষয়টির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি গবেষণা করেছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ফুড প্রোটেকশন (আইএইপি)। তারা এ গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৯০টি বোতল সংগ্রহ করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ৭০ শতাংশ বোতলেই জীবাণুর মাত্রা নিরাপদ মানদণ্ডের চেয়ে বেশি।

স্পেনের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব আ করোনিয়া-এর ট্রান্সলেশনাল অ্যান্ড মাল্টিডিসিপ্লিনারি মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান মারিয়া ডেল মার টমাস বলেন, ‘সাধারণত, এই ধরনের বোতলে যে ব্যাকটেরিয়া জমা হয়, তা হলো কোলিফর্ম, যা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে পাওয়া যায়। সহজভাবে বললে, এগুলো মল থেকে আসা জীবাণু।’

২০১৪ সালের প্রকাশিত এক গবেষণায়ও এ তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখতে পান পুনঃব্যবহারযোগ্য বোতলে এসরেশিয়া কোলি এবং স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াসের মতো বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। এছাড়া অ্যাসপারগিলাসের মতো কিছু ছত্রাক যা দেখতে সাদা হলুদ রঙের হয় এবং পেনিসিলিয়াম যা দেখতে নীল বা সবুজ রঙের।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়াটার ফিল্টার গুরু এক প্রতিবেদনে জানায়, কিছু পুনঃব্যবহারযোগ্য পানির বোতলে টয়লেটের চেয়ে ৪০,০০০ গুণ বেশি এবং কম্পিউটার মাউসের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। যদিও এই তথ্য একটি পানি ফিল্টার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের, তবুও এটি অতিরঞ্জিত নয় বলে মনে করেন মারিয়া ডেল মার টমাস।

অনেক দিন ধরে বোতলে পানি রেখে দিলে এটি ছত্রাকের স্পোর এবং হাতে থাকা ব্যাকটেরিয়ার জন্য এক আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। মারিয়া ডেল মার টমাস ব্যাখ্যা  করে বলেন, “যদি আমরা নিয়মিত পানি পরিবর্তন না করি এবং প্রতিদিন বোতল ধুয়ে না নিই, তবে সেখানে জীবাণু জমে বায়োফিল্ম তৈরি হতে পারে।” বায়োফিল্ম হলো মাইক্রোবদের একটি সম্প্রদায়, যারা কোনো পৃষ্ঠে লেগে থাকে এবং নিজেদের তৈরি সুরক্ষামূলক আবরণে আবদ্ধ রাখে। একবার বায়োফিল্ম তৈরি হয়ে গেলে সেসব ময়লা ও জীবাণু পরিষ্কার করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

বোতলের ধরনও জীবাণু সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, জৈব আবরণের দিক থেকে কাচের বোতল সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে, শক্ত বা নরম প্লাস্টিক এবং ধাতব বোতলগুলোতে ব্যাকটেরিয়া জমার প্রবণতা বেশি। একইভাবে, স্ট্র বা নোজলযুক্ত বোতলগুলোতে দূষণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া গেছে।

বোতল কীভাবে পরিষ্কার করবেন?

আইএএফপি-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৬ শতাংশ ব্যবহারকারী কখনোই তাদের বোতল পরিষ্কার করেন না। এটি একেবারেই করা উচিত নয়। টমাস ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘প্রতিদিন পানি পরিবর্তন করা, ডিটারজেন্ট দিয়ে বোতল ধোয়া এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর পানির সঙ্গে এক ফোঁটা ব্লিচ মিশিয়ে জীবাণুমুক্ত করা উচিত, যাতে বায়োফিল্ম তৈরি না হয়। যদি বোতলটি ডিশওয়াশারে ব্যবহারের উপযোগী হয়, তবে নিয়মিত ডিশওয়াশারে জীবাণুমুক্ত করাই সবচেয়ে ভালো। আরেকটি বিকল্প হলো সমান পরিমাণ পানি ও ভিনেগারে বোতলটি আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা, এতে বেকিং সোডা যোগ করলে ফেনা তৈরি হয় যা আরও ভালোভাবে পরিষ্কার করে। বোতলের সব খোলা অংশ, যেমন স্ট্র এবং ভালভ, যেখানে ছত্রাক ও ফাঙ্গাস জমে থাকে, তা খুলে পরিষ্কার করা এবং পুনরায় ব্যবহারের আগে বোতলটি ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’

মাইক্রোবিয়াল জীবাণু দিয়ে ঠাসা একটি বোতল থেকে পানি পান করলে বড়জোড় বাজে গন্ধ বা বাজে স্বাদের হতে পারে। তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুব বেশি হুমকির নয়। বেশিরভাগ ছত্রাকও কিন্তু তেমন ক্ষতিকর নয়। আমাদের ইমিউন সিস্টেম যদি সুস্থ থাকে তাহলে সেগুলো অনায়াসের আমাদের শরীর মোকাবেলা করতে সক্ষম। এই একই কথা ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে টমাস সতর্ক করে বলেন, যারা ইমিউন সিস্টেম দুর্বল ও বিভিন্ন অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। তাদের স্বাস্থ্যবিধির প্রতিও আরও মনোযোগী হওয়া উচিত।

টমাস বলেন, ‘পানিতে মাইক্রোঅর্গানিজমের কারণে কোনো রোগ সৃষ্টি হতে হলে অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বের পানিতে থাকতে হবে, তাই আমাদের বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আতঙ্ক থেকে নিস্তার পেতে বোতলগুলো নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করাই যথেষ্ট। আর দৃশ্যমান ময়লা পরিষ্কার না হলে সে বোতল ফেলে দিতে হবে।’ সূত্র: এল পাইস।