পানিতে ভাসছে বসতঘর-সড়ক

সুপ্রভাত রিপোর্ট »

ভারি বৃষ্টিপাত ও ঢলের পানিতে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অতি বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া পাহাড় ধসে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি ঢুকে পড়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ঢলের পানি। সড়কগুলো কয়েকফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দুর্গত জনপদে বিশুদ্ধ পানীয়জল ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। সুপ্রভাত প্রতিনিধি ও প্রতিবেদকদের পাঠানো খবর।

বাঁশখালী
বাঁশখালীতে শুক্রবার রাত থেকে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বাসিন্দারা। বিভিন্নস্থানে ছোট-বড় পাহাড়ি ছড়া (ঝর্ণা)’র পার ভেংগে তীব্র বেগে প্রবাহিত হচ্ছে পাহাড়ি ঢল। ৫ দিনের ভারি বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে ভাসছে বাঁশখালী। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অসংখ্য মাটির তৈরি বাড়িঘর ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় আংশিক ভেঙেও পড়েছে। গ্রামীণ জনপদ, পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে, চাষের ক্ষেতগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

এদিকে মঙ্গলবার সকাল হতে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার রাত থেকে ভারী টানা বর্ষণের কারণে বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া, খানখানাবাদ, বাহারছড়া, কাথরিয়া, কালিপুর, বৈলছড়ি, সরল, গন্ডামারা, শীলকুপ, চাম্বল, শেখেরখীল, সাধনপুর ও পুঁইছড়ীতে বন্যার অবস্থা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ফসলি জমি, সবজি ক্ষেত, পানের বরজে ও চাষের বীজতলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে আমার ইউনিয়নে মানুষগুলো বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অসংখ্য বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। সবজি ও মৎস্য ঘেরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খানখানাবাদের চেয়ারম্যান জসিম হায়দার চৌধুরী বলেন, বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি ঢলের পানি আমার এলাকায় এসে বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। গ্রামবাসীর ভোগান্তি চরমে।

চকরিয়া
মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। অতিরিক্ত বর্ষণের কারণে বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপা পড়ে চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ঘুনিয়া এলাকায় রোজিনা আক্তার (৪৮) নামের এক গৃহবধূ নিহত হয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন।

অপরদিকে গতকাল সকালে বাড়ির সামনে থেকে বানের পানিতে ভেসে গেছে ১২ বছর বয়সের কিশোরী। গতকাল দুপুরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবী হোছাইন চৌধুরী। নিহত কিশোরী সাহারবিল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কোরালখালি গ্রামে মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ সেলিম খলিফার মেয়ে। একই পরিবারের আরো একটি মেয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়ি ঢলের তা-বে মাতামুহুরী নদীর কোনাখালী, বিএমচর ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভার দিগরপানখালী মজিদিয়া মাদরাসা এলাকায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ঢলের পানি। এই অবস্থার কারণে চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার দুইশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। তাতে সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদি বলেন, অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বেশিরভাগ এলাকার বসতঘর, টিউবওয়েল, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাঁটু থেকে কোমড় সমান পানি ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থার কারণে দুর্গত জনপদে মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানীয়জল ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো কয়েকফুট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একবারে অচল হয়ে পড়েছে।

সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়নে সোমবার থেকে কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বসতঘর পানিতে ডুবে গেছে।

হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেরজ উদ্দিন মিরাজ, কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বলেন, এবারের পাহাড়ি ঢলের বন্যা চকরিয়ার অতীতের ইতিহাসে রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান বলেন, পুরো বরইতলী ইউনিয়নে বানবাসী মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এমন কোন পরিবার নেই, বরইতলীতে বানের পানি ঢুকেনি।

কোনাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার ও বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সোমবার পাহাড়ি ঢলের পানির তা-বে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ এখনো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল ধাক্কায় সোমবার রাতে চকরিয়া শহররক্ষা বাঁধের কয়েকটি অংশ ভেঙে গিয়ে মাতামুহুরী নদীর পানি ধেয়ে আসে চকরিয়া পৌরশহরের বাণিজ্যিক জনপদে। কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত ঢলের পানি চকরিয়া শহরের বেশিরভাগ মার্কেটে ঢুকে পড়ে। এতে কয়েকশ দোকানদার মালামাল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

ভাঙনের আশঙ্কা থাকায় চকরিয়া পৌরসভার দিগরপানখালী পয়েন্টে সোমবার রাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম এর সহযোগিতায় বালুর বস্তা ফেলে এলাকাটি রক্ষায় কাজ করা হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি এখনো নাজুক অবস্থা রয়েছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা বানের পানি যাতে সহজে নেমে যেতে পারে সেইজন্য উপকূলের স্লুইসগেট গুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।

টেকনাফ
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি-চিংড়িঘেরও। প্রাণহানি রোধে পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছে উপজেলা প্রশাসন।

মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টানা কয়েকদিন ভারি বর্ষণের কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৫ হাজার মানুষ। ফলে টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভী বাজার, ওয়াব্রাং, চৌধুরী পাড়া, দরগা, রঙ্গিখালী লামার পাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের, হারিয়াখালী, কাটাবনিয়া পাড়া, লাপারঘোনা, বাহারছাড়া পাড়া, কুড়া বুইজ্জ্যাপাড়া, মুন্ডার ডেইল পাড়া, শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া, মাঝের পাড়া, জালিয়া পাড়া বসবাসকারী আড়াই হাজার পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি টেকনাফ পৌরসভার ১২টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে ২০ হাজার মানুষ।

টেকনাফ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড পুরাতন পল্লানপাড়া পাহাড়ের তীরে বসবাসকারী মো. ইসলাম বলেন,‘টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে ভয়ে আছি। এ সময় নির্ঘুম রাত কাটে। অন্য সময় তেমন একটা ভয় কাজ করে না। ভারী বর্ষণের পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন শাহপরীর দ্বীপের ঘোলার পাড়ার বাসিন্দার মো. আমিন। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি ঢুকেছে, ফলে ঘরের সবকিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। সকাল থেকে শুধু চনামুড়ি খেয়ে দিন পার করছি। কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। আমাদের আশপাশের ১০/১৫টি পরিবার রয়েছে। সবার ঘরবাড়ি ডুবে গেছে।’

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান-৩ ফারিহা ইয়াসমিন বলেন, টানা কয়েকদিন ভারী বর্ষণে শাহপরীর দ্বীপের কয়েকটি এলাকার দুই শতাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি।’

এব্যাপারে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওর্য়াডের সদস্য মো. সেলিম বলেন, ‘ভারী বর্ষণের কারণে আমার এলাকায় প্রায় দেড়শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভারি বর্ষণে কয়েকটি গ্রাম মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। পাশাপাশি অতিভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের সম্ভবনা রয়েছে। তাই সোমবার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাকারীদের অন্যত্রে সরে যেতে বলা হয়েছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্র চলে গেলে পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়া পাহাড়ে পাড়দেশে বসবাসকারী জান-মালের রক্ষায় সিপিপির সদস্যরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রেখেছি।’

খাগড়াছড়ি
টানা কয়েকদিনের বর্ষণে খোদ খাগড়াছড়ি জেলাশহরেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের আশংকা দেখা দিয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে ছোট খাটো পাহাড় ধসের খবরও পাওয়া গেছে। পাশাপাশি আন্তঃজেলা উপজেলা সংযোগ সড়কগুলোর কোথাও কোথাও পাহাড় ধসের কারণে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।

বিশেষ করে জেলা শহরের শালবন, রসুলপুর, কুমিল্লা টিলা, সবুজবাগসহ যেসব এলাকায় পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে; সেসব এলাকায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি বেশি। এই বর্ষায় অধিকাংশ পাহাড় ধসের ঘটনাই মূলত পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করার ফলে। সেসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে প্রশাসন এবং পৌরসভার পক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষের জরুরি মাইকিংয়ের পরও বাসিন্দারা ঝুঁকি নিয়ে স্ব স্ব এলাকায় অবস্থান করছেন।

গেলো কয়েকদিনের বৃষ্টিতে শালবনের হরিনাথপাড়া গ্যাফের বাসিন্দা মজিবুর রহমানের অটো রিক্সার গ্যারেজের ওপর পাহাড় ভেঙে পড়েছে। তার বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেবল মজিবুর রহমানই নন; আশাপাশে বসতি স্থাপনকারী প্রায় সব বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি পাহাড় ধসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রসুলপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বহু মানুষ মাটি সরাতে ব্যস্ত। যারাই পাহাড় কেটে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন, তাদের অধিকাংশই এখন ক্ষতির শিকার।

জেলা সদরের কদমতলীর সড়ক ও জনপদ বিভাগের পিছনে রেস্টহাউজ সংলগ্ন পাহাড় ও মো. আব্দুল মান্নান এর বাড়ির পিছনে রাস্তায় ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে এতে করে যেকোন মুহূর্তে এ রাস্তাটি দিয়ে চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও জেলা শহরের কলাবাগান, শালবাগান, মোহাম্মদপুর,সবুজবাগসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসের খবর পাওয়া গেছে। এসকল ঝুঁকিপূর্ণদের রক্ষায় স্থানীয় প্রসাশন সতর্ক রয়েছেন।

যদিও ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা বলছেন, তারা প্রতি বছর বর্ষা এলে ঝুঁকিতে ও আতংকে বসবাস করেন। প্রশাসন তাদের জন্য স্থায়ী কোন সমাধান করে দেন না। তাই তারা বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে মাটিরাংগার ৯১টি পরিবারসহ পুরো জেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে।

সাদ্দামের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার বলেন, সকাল ৬টার দিকে আমরা ঘরে ছিলাম। হঠাৎ করে বাঁশ ঝাড়সহ পাহাড় ধসে আমাদের ঘরের উপর পড়লে ঘরের ওয়াল ভেঙে খাটের উপর পড়ে। আমরা তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। মানিকছড়ি উপজেলায় হালদা নদীর উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে নদীর দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা।

দীঘিনালা উপজেলার মধ্যে মেরুং এলাকায় মাইনী নদীর পানি উপচে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম লাকি জানান, তাঁর ইউনিয়নে কমপক্ষে এক হাজার পরিবার পানিবন্দি। মৌসুমী ফসল, ধান এবং শাক-সবজির বিপুল ক্ষতি হয়েছে। কবাখালী ইউপি চেয়ারম্যান নলেজ চাকমা জানান, তাঁর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

এদিকে টানা বর্ষণের কারণে খাগড়াছড়ির নদ-নদীতেগুলোতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলার চেঙ্গী ও মাইনি নদীর তীরবর্তী নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে জেলা শহরের মুসলিমপাড়া, গঞ্জপাড়া, খবংপুড়িয়া, বাঙ্গালকাটি, বটতলী, কালাডেবা প্রভৃতি এলাকার প্রায় ৩ শতাধিক পরিবার পানিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। মাইনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের প্রায় ৪ শতাধিক পরিবার পানিতে আটকা পড়েছেন।

ইতিমধ্যে খাগড়াছড়ির মুসলিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে ২০টির মতো পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া দীঘিনালার ৫টি কেন্দ্রে একশ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।

খাগড়াছড়ি পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহ আলম জানান, পানি বাড়তে থাকায় আরো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। সেজন্য খাগড়াছড়ি পৌর এলাকায় প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রিতদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও উপকরণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা রাজেশ বড়ুয়া জানিয়েছেন, ‘জনগণকে সচেতন করতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। তাদেরকে নিরাপদ স্থানে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।’

খাগড়াছড়ি পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহ আলম জানান, ‘মেয়রের নির্দেশে সব ধরণের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানিয়েছেন, ঝুঁকির আশংকায় জেলা শহরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি সেন্টার মিলে ১০টি এবং প্রত্যেক উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

চন্দনাইশ
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত ৫দিনের অবিরাম বর্ষণে এ পানি বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় উপজেলার সাঙ্গু নদী-বিভিন্ন খালের পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন উপজেলার ধোপাছড়ি, দোহাজারী পৌরসভা, বৈলতলী, বরকল, বরমা, চন্দনাইশ পৌরসভা, সাতবাড়িয়া, কাঞ্চনাবাদ, হাশিমপুর ও জোয়ারা ইউনিয়নের বাসিন্দারা। টানা বৃষ্টিতে দোহাজারী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বন্যায় পাবিত এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা যাবে না।

উপজেলার বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সড়কসহ পানিতে ডুবে গেছে মহাসড়কও। সড়কে পানি বাড়তে থাকলে সোমবার রাত থেকেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল কমে যায়। মঙ্গলবার সকালে চন্দনাইশ এলাকার সড়কে পানিতে টইটুম্বুর দেখা গেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের ওপর দিয়ে প্রবল ¯্রােতে পানি বয়ে যাচ্ছে। ফলে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচল অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। তাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যান চলাচল বন্ধ করা হয়।

শত শত একর জমির রবি শস্য বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলার বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের খামার। এমনকি বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় রান্না বান্না করতে না পেরে অনেক পরিবারকে উপোষ থাকতে হচ্ছে।

সাঙ্গু নদীর সাতকানিয়া অংশের কালিয়াইশ ইউনিয়নের পূর্ব কাটগড়, পশ্চিম কাটগড়, মাইঙ্গ্যাপাড়া, আলমগীর, বাজালিয়া ও পুরানগড় ইউনিয়নের অনেক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

দোহাজারী পৌরসভার কৃষক ফয়েজুর রহমান জানান, বন্যার পানি কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। রবি শস্য এবং আউশ ধানের রোপণকৃত চারা ও বীজ তলা পানিতে তলিয়ে গেছে। আমার সবজি ক্ষেতে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বরকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, আমার বরকল ইউনিয়নে ৮০ শতাংশ মানুষ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

ধোপাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল আলিম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের প্রায় শতভাগ মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। সবার ঘরে উঠেছে বন্যার পানি। অনেক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিমরান মোহাম্মদ সায়েক এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, উপজেলার পানি বন্দি এলাকার শুকনো খাবার, পানি বিশুদ্ধ করণ ট্যাবলেট, স্যালাইন ও চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

রাঙামাটি
টানা সাতদিনের বর্ষণে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে পার্বত্য জনপদ রাঙামাটি। বড় ধরণের পাহাড়ধসের ঘটনা না ঘটলে পুরো জেলার বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবার বিকাল অবধি অন্তত ২৩৫টি স্থানে ছোটবড় ধস বা ভাঙনের তথ্য জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। এইসব ধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৮১টি বসতঘর, যার মধ্যে রয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১০টি ঘরও। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি ভারী বর্ষণে জেলার বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি,বিলাইছড়ি, বরকল আর কাপ্তাইয়ের বেশ কয়েটি নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়েছে, যাতে পানিবন্দি হয়েছেন ত্রিশ হাজার মানুষ। কর্ণফুলি নদীতে ¯্রােতের প্রবাহ ভারী থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে ফেরি চলাচল। সড়কে পাহাড় ধসে পড়ায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার সাথে দীঘিনালা উপজেলা হয়ে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ। রাঙামাটি আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৬৮.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ৪৬.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা আগের দিনের চেয়ে কিছুটা কম। বৃষ্টিপাতের কারণে কাপ্তাই হ্রদে পানির উচ্চতা বেড়েছে। পানির প্রবাহ ভালো থাকায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনও বেড়েছে।

মঙ্গলবার সকালেও শহরের রিজার্ভমুখসহ কয়েকটি স্থানে ধসের ঘটনা ঘটেছে। সকালে রির্জাভমুখ এলাকায় মাটি ধসে ঘরে ভেতর ঢুকে পড়ে। এসময় কোতয়ালি থানা পুলিশের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ১৭ পরিবারের ৬০ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, পুরো জেলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৩৫ স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। ৩৮১ বসতঘর ধসে গেছে। ২৪২টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে তিন হাজার মানুষ অবস্থান করছে। পাহাড়ধসে প্রাণহানি না হলেও আহত হয়েছেন ১০ জন।