‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমাগতভাবে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে বিএনপি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে তাদের যে দহরম-মহরম তা বহু পুরনো। এর প্রমাণ হচ্ছে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বৈঠক, যা নিন্দনীয়।’
গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ‘মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, দৈনিক আজাদী এবং গণতন্ত্র’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য শেষে সাংবাদিকরা সৌদি আরবের জেদ্দায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র গোপন বৈঠকের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি এ কথা বলেন। মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ৫৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতি এ সেমিনারের আয়োজন করে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বিএনপিকে ৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। এটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন। সুতরাং তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছে।
স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতির সভাপতি এসএম জামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে সেমিনারে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন সাবেক সিটি মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ, দৈনিক আজাদী সম্পাদক লায়ন এমএ মালেক, রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার বাবুল, মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম সিইনসি প্রমুখ।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, প্রকৃতপক্ষে যখন করোনা ভাইরাসে পৃথিবী স্তব্ধ, মানুষ শঙ্কিত ভবিষ্যৎ নিয়ে, মানুষজন প্রচ-ভাবে উদ্বিগ্ন সে সময়ে বিএনপি জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্রের বৈঠক করে বেড়াচ্ছে। তার প্রকাশ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বৈঠক, যা প্রচ- নিন্দনীয়।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপি অতীতে ষড়যন্ত্রের পথ অবলম্বন করে যে এগুতে পারেনি তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে সক্ষম। না হলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে মানুষ পর পর রায় দিয়ে তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাতো না। তাই বিএনপিকে অনুরোধ জানাব, ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করে মানুষের পাশে দাঁড়ান, এই ষড়যন্ত্র করে কোন লাভ হবে না।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমালোচনাকে সমাদৃত করার সংস্কৃতি লালন করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ মনে করে সমালোচনা পথ চলাকে শাণিত করে। সমালোচনা কাজকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। সেজন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের বিকাশের নীতি নিয়ে সরকার কাজ করছে।
তিনি বলেন, যখন ২০০৯ সালে সরকার গঠন করি তখন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৪শ’। এখন বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্র সাড়ে ১২শ’। তখন অনলাইন পত্রিকা ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। এখন কয়েক হাজার অনলাইন পত্রিকা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। প্রাইভেট টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি তখন প্রাইভেট টেলিভিশন ছিল দশটা। এখন ৩০টি প্রাইভেট টেলিভিশন সম্প্রচারে আছে, ৪৫টি প্রাইভেট টেলিভিশনের জন্য লাইসেন্স দেয়া আছে। এর বাইরে চারটি সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু আছে। সংবাদ মাধ্যমের এই যে এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ সেটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সংবাদপত্র যে ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে অনেক উন্নত দেশেও কিন্তু সংবাদপত্রের এমন স্বাধীনতা নাই। ইউকে’তে ১৬৭ বছরের পুরনো পত্রিকা ছিল ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। সেটি পৃথিবীর বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ছিল একসময়। সেই পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। একটি ভুল সংবাদ পরিবেশনের কারণে মামলা হয়েছিল। মামলার পর তাদের ওপর বিরাট জরিমানা করেছে আদালত, সেই জরিমানা দিতে না পেরে কোম্পানি পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, একজন এমপির বিরুদ্ধে ভুল বা অসত্য সংবাদ পরিবেশনের কারণে বিবিসির পুরো টিমকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ইউকে এবং কন্টিনেন্টাল ইউরোপে হরহামেশা ভুল এবং অসত্য সংবাদ পরিবেশনের কারণে পত্রিকা এবং গণমাধ্যমকে জরিমানা দিতে হয়। আমাদের দেশে তা কখনো হয়নি। সংবাদপত্র এ সমস্ত কারণে বন্ধ হয়নি। সেজন্য বলছি অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে।
সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সিঙ্গাপুরে মাত্র কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল, সবগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত। থাইল্যান্ডে সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেলের ফিড সরকার নিয়ন্ত্রিত। সেখানে যদি সরকারের অপছন্দনীয় কোন কন্টেন্ট থাকে সেটা বাদ দেয়া হয়। আমাদের দেশে তা হয় না। কারণ মনে করি স্বাধীন মতপ্রকাশ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সেটি বহুমাত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করে।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে গত ষাট বছর ধরে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে ধারণ করে, স্বাধীনতার চেতনা এবং স্বাধীনতার পূর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দৈনিক আজাদী পত্রিকা নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সেজন্য দৈনিক আজাদী পত্রিকা নিশ্চয়ই সমাজ এবং রাষ্ট্রের ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকার রাখে। এজন্য দৈনিক আজাদী পত্রিকা পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই।
স্বাধীনতার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পর্কে তথ্যমন্ত্রী বলেন, দৈনিক আজাদী পত্রিকা বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে একটি। ঢাকার অনেক পত্রিকার চেয়ে দৈনিক আজাদী পত্রিকার সার্কুলেশন অনেক বেশি। এই কৃতিত্ব প্রথমত ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের, তিনি দূরদৃষ্টি নিয়ে এই পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে যারা এই পত্রিকার হাল ধরেছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকাকে অত্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালনা করে আসছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যখন অন্য পত্রিকা ছাপেনি তখন দৈনিক আজাদী পত্রিকা ছেপেছে। সেজন্য দৈনিক আজাদী পত্রিকা পরিবার গর্ব করে বলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা। আজাদী শুধুমাত্র পত্রিকা নয়, একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। একটি পত্রিকা বা একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সহজ কাজ নয়।
সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইঞ্জিনিয়ার খালেক দৈনিক আজাদীর আগে কোহিনূর পত্রিকা প্রকাশ করেন, এর কপি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। সৈয়দ আহমেদ ছিরকোটি, তৈয়্যব শাহ, তাহের শাহ হুজুর যে এখানে আসেন সেটার ধারাবাহিকতার সূত্র করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার খালেক। আজকে যে সুন্নিয়া মাদরাসা তার একজন ফাউন্ডার ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক।
সাবেক এই মেয়র বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আজাদী পত্রিকার যে অবদান তা চট্টগ্রামবাসীকে তথা বাংলাদেশের আপামর জনগণকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেয়া এবং সাধারণ নাগরিককে মুক্তিযোদ্ধাকে সমর্থন করার জন্য লেখনি ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আজাদী।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, আজাদী পত্রিকা এবং চট্টগ্রাম এক ও অভিন্ন। আজাদীকে বাদ দিলে চট্টগ্রাম হবে না এবং চট্টগ্রামকে বাদ দিলে আজাদী হবে না। এভাবে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চট্টগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন। তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর প্রেসে গিয়ে কোন বেকার ছেলে কাজ ছাড়া ফেরত আসেনি।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন আমার বাবা। আবার অত্যন্ত ধার্মিকও ছিলেন তিনি। আজান দিলেই সবকিছু ছেড়ে জামায়াতে নামাজ পড়তেন। ১৯৬০ সালে দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর, সেদিন ছিল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। নবী প্রেমের কারণেই দিনটি বেছে নেন বাবা।
তিনি বলেন, যখন দৈনিক আজাদী বের হয় তখন অর্গানাইজ কোন হকার ছিল না। উনি (ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক) সকালে মসজিদ থেকে আসার সময় হকারদের ধরে নিয়ে আসতেন। তাদের পত্রিকা দিতেন এবং পয়সা নিতেন না। তখন কাগজের দাম ছিল দুই আনা। একজনকে ১০টা কাগজ করে পাঁচদিন দিতেন। পাঁচদিন পর হকারদের বলতেন, যে টাকা জমেছে সেটা আমার, তবে তোমাদের কাছ রাখ। এবার টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে কাগজ কিনে নিয়ে যাও। এর মধ্য দিয়ে তিনি হকারদের ক্যাপিটেল দেন, কোন ঋণ দেননি। আজাদী সম্পাদক বলেন, স্বাধীন দেশে প্রথম সংবাদপত্র আমরা বের করেছিলাম। সংবাপত্রের ইতিহাস লেখা হলে আজাদীর নাম বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে লিখতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ বলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকট ছিল বলেই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর মত লোভনীয় পদ ছেড়ে দিয়ে পত্রিকা প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তিনি বলেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যত উত্থান-পতনের ঘটনা আমরা আজাদীর মাধ্যমে জানতে পারতাম।
আনোয়ারুল আজিম আরিফ আরো বলেন, যখন অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া কার্যকর ছিল না সে অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ার খালেক বুঝতে পেরেছিলেন, জাতিকে যদি জাগাতে হয় সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এটা ছিল তাঁর দূরদর্শিতা। যেটা সবার থাকে না। বিজ্ঞপ্তি
এ মুহূর্তের সংবাদ