পাঁচ বিভাগে আনসারের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন গঠনের পরিকল্পনা

সুপ্রভাত ডেস্ক »

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর আরও জোর দিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের পাঁচটি বিভাগে নতুন করে আনসারের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের পাশাপাশি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর জনবল সংকট কাটানো ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নতুন পাঁচটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হচ্ছে। চলতি বছরের ২৮ জুলাই মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর প্রস্তাবনার কাজ বাস্তবায়ন শুরু হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এটার কাজ মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। এখন ফাইল অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে। আশা করছি খুব দ্রুত এসব কাজ সম্পন্ন হবে। অনুমোদনের পর পাঁচটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠনের বাজেট নিয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি এসব ব্যাটালিয়ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেপিআইভুক্ত এলাকায় কাজ করবে।

কোথায়-কোথায় হচ্ছে ৫ ব্যাটালিয়ন, প্রশিক্ষণ কীভাবে

নতুন পাঁচ ব্যাটালিয়নকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি শহরে দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রথমটিকে রাখা হবে ঢাকার জন্য, দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নকে বরিশাল সদরে, তৃতীয়টিকে চট্টগ্রাম, চতুর্থ ব্যাটালিয়নকে রংপুরের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকা এবং সর্বশেষ পঞ্চমটিকে দায়িত্ব দেওয়া হবে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায়। প্রতিটি ব্যাটালিয়নে ৪২৫ জন করে বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা ও সিপাহি দায়িত্ব পালন করবেন।

জানা যায়, পাঁচটি ব্যাটালিয়ন গঠন এবং মোট ২ হাজার ১২৫টি স্থায়ী পদ সৃজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব পদের মধ্যে পরিচালক, উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালক পদে ২০ জন থাকবেন বিসিএস আনসার ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

প্রস্তাবনা অনুযায়ী— ২ হাজার ১২৫টি পদের মধ্যে ৫ জন পরিচালক, ৫ জন উপপরিচালক, ১০ জন সহকারী পরিচালক, ২০ জন সার্কেল অ্যাডজুট্যান্ট, ৯০ জন সুবেদার, ১০০ জন নায়েব সুবেদার, ১২০ জন হাবিলদার, ২০০ জন নায়েক, ৩৯০ জন ল্যান্স নায়েক, ১ হাজার ১৮০ জন সিপাহী এবং ৫ জন নার্সিং সহকারীর পদ সৃজনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।

সাধারণত আনসার সদস্যদের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগে এই পাঁচ ব্যাটালিয়নকে মাঠে নামানোর জন্য প্রয়োজনে চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে পারে। আবার সরকারি বন্ধের দিনগুলোতে সাধারণত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না বা পিটি-প্যারেড হয় না। কিন্তু, সরকার চাইলে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় শুক্র, শনি ও সরকারি দিনগুলোতে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই গ্যাপটা পূরণ করা হতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করছে কত দ্রুত এই পদ সৃজন কার্যক্রম শেষ হয়, সেটার ওপর।

কেন গঠন করা হচ্ছে এই পাঁচ ব্যাটালিয়ন?

দেশে বর্তমানে মোট ৪২ ব্যাটালিয়ন আনসার রয়েছে। এদের মধ্যে ৩৯টি পুরুষ ব্যাটালিয়ন। দুটি নারী আনসার ব্যাটালিয়ন এবং বাকি একটি আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন বা এজিবি।

আনসারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ৩৯তম ব্যাটালিয়ন সৃষ্টির পর ৮ থেকে ৯ বছর অতিবাহিত হলেও নতুন কোনো ব্যাটালিয়ন তৈরি করা হয়নি। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কক্সবাজারের উখিয়াসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় প্রচুর সংখ্যক আনসার সদস্যকে মোতায়েন করতে হয়েছে। ফলে নির্বাচন ঘিরে এসব সদস্যকে এনে আবার নির্বাচনী ডিউটির জন্য মোতায়েন করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তারা আরও বলছেন, সমতলে যেসব সদস্য রয়েছে তাদের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে নতুন ব্যাটালিয়ন গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া, ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও ১০ থেকে ১২ জন করে আনসার সদস্য মোতায়েন থাকে। এসব কারণে নির্বাচনের জন্য সৈনিক সংকট তৈরি হয়েছে। সুতরাং জনবল স্বল্পতা এবং জাতীয় নির্বাচন— এই দুই বিষয় সামনে রেখে নতুন এই পাঁচটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হবে।

সাধারণত আনসার সদস্যরা প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর এলএমজি ও অ্যাসল্ট রাইফেল বা চায়না রাইফেল নিয়ে ডিউটি করেন। এসব রাইফেল সাধারণত ৭.৬২*৩৯ মি.মি. ক্যালিবারের হয়ে থাকে এবং তাদের সবগুলো অস্ত্র বেশ পুরোনো মডেলের। তবে, নতুন এই ব্যাটালিয়ন সদস্যরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত থাকবেন।

ব্যাটালিয়ন অনুমোদন হলেও চ্যালেঞ্জ অবকাঠামো

আনসারের ৩৯তম ব্যাটালিয়ন গঠন হয় মানিকগঞ্জে। কিন্তু সেখানে এখন অবধি কোনো অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের কার্যালয়ের পাশে আনসারের এই ব্যাটালিয়ন রয়েছে। সেখানে একটি ভবনের কাজ শুরু হয়।

সেখানের বেশিরভাগ সৈনিক বিটিভি ও লালবাগ কেল্লাসহ কয়েকটি জায়গায় মোতায়েন রয়েছে। সুতরাং ব্যাটালিয়ন অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গেই অবকাঠামো বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যে নিশ্চিত হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সুতরাং নতুন এসব ব্যাটালিয়নের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা এসব সৈনিকদের থাকার জায়গাও নেই।

শুধু নির্বাচন নয়, দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা কাঠামোর পরিকল্পনা জরুরি

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যও বড় পরীক্ষা। বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ, ভোটকেন্দ্র সুরক্ষা এবং কেন্দ্রীয় স্থাপনাগুলোর পাহারায় আনসার বাহিনীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে ৪২টি ব্যাটালিয়নে প্রায় ১৮ হাজার সদস্য থাকলেও এর বড় অংশ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রকল্পে ব্যস্ত থাকায় নির্বাচনী সময়ে পর্যাপ্ত জনবল হাতে থাকে না। নতুন পাঁচটি ব্যাটালিয়ন গঠনের সিদ্ধান্ত তাই সময়োপযোগী।

তিনি বলেন, এখানে দুটি ঝুঁকি আছে— প্রথমত, দ্রুত নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ শেষ করতে গিয়ে যদি মানদণ্ডে ছাড় দেওয়া হয়, তবে মাঠে কার্যকারিতা কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো ও আধুনিক অস্ত্রের অভাব থাকলে তারা দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনে সমস্যায় পড়বে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন শুধু একদিনের ঘটনা নয়, আগে ও পরে কয়েক সপ্তাহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। তাই এই ব্যাটালিয়নগুলোকে শুধু নির্বাচনের জন্য নয়, দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ হিসেবে পরিকল্পনা করা জরুরি।

পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, আধুনিক অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত না হলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন— আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ঘোষণার পরপরই নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। ভোটকেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতিসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

অপরদিকে জাতীয় নির্বাচনের সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদার করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা বা সহিংসতা রোধে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আনসার সদস্যদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মজবুত করার উদ্দেশ্যে আনসার বাহিনীতে জনবল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।