কুতুপালং শিবিরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষ
# ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে
শত শত রোহিঙ্গা পরিবার
# এনজিওকর্মীদের ক্যাম্প থেকে ফেরার নির্দেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন ও পুরাতন রোহিঙ্গাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে এখন। সংঘর্ষের ঘটনায় গত পাঁচদিনে এক নারীসহ ৮ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন নারী-পুরুষ ও শিশুসহ অন্তত শতাধিক। এছাড়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে শতাধিক ঝুপড়ি ও ৫০টি দোকান ভাঙচুর হয়েছে। সংঘর্ষের কারণে ইতোমধ্যে আতংকে সাধারণ ৫শ’ রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্প-১ থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য ক্যাম্প ও আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট এনজিওসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এনজিওকর্মীদের দ্রুত ফিরে আসতে নির্দেশ দিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মকর্তাদের স্ব স্ব এনজিওর পক্ষ থেকে এ নির্দেশ দেয়া হয় বলে জানা গেছে। গত ৫ অক্টোবর সকালে র্যাব অভিযান চালিয়ে ৯ জন রোহিঙ্গা ডাকাতকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দিন দিন রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। শিবির থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাঁটাতারের বেড়াও তারা মানছে না।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে আনাস ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। গত ১ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। সকালে সমিরা আক্তার (৪১) নামের একজনকে মৃত উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত সমিরা কুতুপালং ৩ নম্বর ক্যাম্পের এফ-ব্লকের মৃত ছৈয়দ আলমের মেয়ে। ৪ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুগ্রুপের সংঘর্ষে ভোর ৪টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের ২ ওয়েস্ট এর ডি-৫ ব্লকের মৃত সৈয়দ আলমের ছেলে ইমাম শরীফ (৩২) ও ডি-২ ব্লকের মৃত ইউনুসের ছেলে শামসুল আলম (৪৫) নামে দুই রোহিঙ্গা নিহত হন। ৫ অক্টোবর রাত ১১টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত আনাস ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষে মোহাম্মদ নাসিম (২৪) নামে এক রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত যুবক কুতুপালং ডি-৪, ২ ওয়েস্ট ক্যাম্পের মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় দু’গ্রুপের মধ্যে ফের সংঘর্ষ হয়। এতে স্থানীয় দুজনসহ ৪ জন নিহত হন। স্থানীয়রা হলেন- হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালীর বাসিন্দা নোহা গাড়িচালক নরুল হুদা, অপরজন হেলপার আবুল বশর। তাদের দু’জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। নিহত অপর দুজন শীর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মুন্নার ভাই। একজনের নাম গিয়াস উদ্দিন আরেকজনের নাম ফারুক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সূত্রে ৪জন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ক্যাম্প-১ থেকে ৫শ’ রোহিঙ্গা
পরিবার পালিয়েছে
কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ জানান, আনাস গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৫’শ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্প অভ্যন্তরের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছে। কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের হেডমাঝি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, দুগ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরি ও লাঠির আঘাতে কমপক্ষে ১০০ জন আহত হয়েছে। আহতদের কয়েকজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও কুতুপালং এনজিও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ডাকাত আটক
র্যাব : ১৫-এর উপঅধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান জানান, গত কয়েকদিন ধরে কুতুপালং ক্যাম্পে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলছিল। এতে বেশ ক’জন রোহিঙ্গা মারা যায়। তিনি বলেন, আমাদের অভিযান টের পেয়ে রোহিঙ্গা ডাকাতেরা কুতুপালং ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পরে র্যাব তাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে গত মঙ্গলবার সকালে তাদের ধাওয়া করতে করতে চাকমারকুল পাহাড়ি এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় চারটি অস্ত্র, ২০ রাউন্ড গুলি ও কয়েকটি কিরিচ উদ্ধার করা হয়। আটককৃত ৯ জনই রোহিঙ্গা ডাকাত। তাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষে থানায় সোপর্দ করা হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এনজিও কর্মীদের সরিয়ে আনা হচ্ছে
গত কয়েক’দিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে এনজিওকর্মীদের সরিয়ে আনা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মকর্তাদের স্ব স্ব এনজিওর পক্ষ থেকে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। এনজিওকর্মীরা যাতে ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে পারেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়। প্রত্যেক এনজিওকর্মীকে এ সংক্রান্ত বিশেষ জরুরিবার্তা দেয়া হয়েছে। বিশেষবার্তা পাওয়ার পরপর এনজিওকর্মীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে কক্সবাজারে ফিরতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এদিকে দেশি-বিদেশি দাতাসংস্থাগুলোর কারসাজিতে পরপর দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকা- ও সহিংস তৎপরতা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদদৌজা জানান, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে রেজিস্টার্ড এবং আন-রেজিস্টার্ড কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে পুলিশ টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।