বারী সুমন :
‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো’ চৈত্রের শৈষদিন গিয়ে যখন বৈশাখের প্রথম দিন আসে, সূর্য ওঠার আগে থেকেই বাজতো এই গান। অন্যরকম এক অনুভূতিতে সকালের ঘুম ভাঙতো। যখনকার কথা বলছি, আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। এখনকার মতো এতো তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না। মাঝে মাঝে রেডিওতে গানগুলো শুনতাম। গ্রামের হঠাৎ দু-একটা বাড়িতে টেলিভিশন দেখা যেতো। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠেই পান্তা খাওয়ার ধুম পড়তো। অবশ্য এখনকার মতো লোক দেখানো গরমভাতে পানি ঢেলে খাওয়া হতো না বা বৈশাখ উপলক্ষে একদিনের জন্য পান্তা খাওয়া হতো না। তখনকার সময়টাই এমন ছিল যে, মানুষ প্রায় প্রতি সকালেই পান্তাভাত খেতো।
১ বৈশাখকে ঘিরে গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বাউল গান, পালাগান, গ্রামীণ কিচ্ছা এবং বাহারি খাবারের আয়োজন করা হতো। গ্রামের আরেকটি ঐতিহ্যের বিষয় ছিল মেলা। কোনো নদীর তীরে বা বড় বটগাছের নিচে যেখানে বিস্তৃত জায়গা রয়েছে সেখানে বসতো মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসতো মেলায়।
১ বৈশাখ সকাল থকেই ঘরে ঘরে চলতো রান্নাবান্নার আয়োজন। তবে সে আয়োজনটা থাকতো প্রতিদিনের চেয়ে একটু আলাদা। বিশেষ কিছু রান্নার পাশাপাশি অবশ্যই পায়েস রান্না হতো। বৌ-ঝিরা সকাল থেকেই আনন্দের সাথে রান্নাবান্নায় অংশগ্রহণ করতো। মেয়েরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসতো বৈশাখ উপলক্ষে। জামাইরা আসতো শ্বশুড়বাড়িতে, এটা যে কত আনন্দের একটা উৎসব ছিল তা বলে বোঝানো কঠিন। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে তা রূপকথার গল্পের মতো লাগবে।
কয়েকদিন আগে থেকেই চলতে থাকতো মেলার প্রস্তুতি। গ্রামের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসতো এ মেলা।
মেলায় পাওয়া যেত গৃহস্থালি নানান জিনিসপত্র। সেই সাথে থাকতো মুড়ি-মুড়কি আর খেলনা। ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দের কোনো সীমা থাকতো না। তারা মেলা থেকে, বাঁশি, মাটির তৈরি পুতুল, পালকি, খেলার হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি কিনতো। মেলা থেকে জিনিস কেনার জন্য পূর্বে থেকেই তারা বাঁশের পালায় (ঘরের খুঁটিতে) গর্ত করে পয়সা জমাতো। চারদিকে শিশুদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতো। মেলায় আরও থাকতো নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বানরের খেলা, যা দেখে সবাই খুব আনন্দ পেতো। শিশু থেকে শুরু করে বড়রাও এই আনন্দ ভাগ করে নিতো কার্পণ্য করতো না। সন্ধ্যার পর মেলায় শুরু হতো বাউলগানের আসর। সারাদিনের কাজ শেষ করে দলে দলে লোকজন গান শোনার জন্য মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতো। গভীর রাত পর্যন্ত চলতো মেলার কার্যক্রম সেই সাথে বাউল, জারি, সারি গান। ক্ষেত্রভেদে মেলার সময়কাল। এটি এক থেকে সাতদিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতো।
অন্যদিকে কোনো কোনো বাড়িতে আয়োজন করা হতো কিচ্ছাগানের। কয়েকবাড়ির মানুষ চাঁদা উঠিয়ে এই কিচ্ছার আয়োজন করতো। গায়কেরা দুপুরের মধ্যেই চলে আসতো এবং বিকেল থেকেই শুরু হতো গান। এসব গান শোনার জন্য আর গায়কদের ভঙ্গিমা দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমাতো। গায়কের বয়ানে কখনও হেসে কুটি কুটি হতো, কখনও বা চোখের পানিতে ভাসতো। কিচ্ছাপালাগুলো এমনই ছিল, যেখানে এক পরিবারের সবাই বসে উপভোগ করতে পারতো। কোনো অশ্লীলতার ছোঁয়া ছিল না, বরং শিক্ষণীয় নানান বিষয় থাকতো।
কেউ কেউ আয়োজন করতো লাঠিখেলার। বাহারি পোশাক পরে বাদ্যের তালে তালে এই লাঠিখেলা প্রদর্শন করতো খেলোয়াড়েরা। নানান কলাকৌশলে পরিপূর্ণ লাঠিখেলা দেখে জনগণ তৃপ্তিলাভ করতো। কোথাও কোথাও আয়োজন করা হতো ষাঁড়ের লড়ায়ের। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই প্রচার করা হতো ষাঁড়ের লড়াই হবে। দলে দলে লোকজন ষাঁড়ের লড়াই দেখার জন্য যেতো। জয়ী ষাঁড়মালিকের জন্য থাকতো পুরস্কারের ব্যবস্থাও। এছাড়াও সারাগ্রাম জুড়ে বিভিন্ন খ- খ- অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হতো পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষকে।
এছাড়া আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎসব ছিল হালখাতা। ক্রেতাগণ সারাবছর দোকান থেকে বাকিতে পণ্য ক্রয় করতেন। দোকানিরাও তাদের বাকিতে পণ্য দিতেন। তবে যখন হালখাতার আয়োজন করা হতো তখন সমস্ত টাকা পরিশোধ করে দিতো। তবে সে হালখাতাটাও ব্যবসায়ীরা ১ বৈশাখ উপলক্ষে করতেন। ব্যবসায়ীরা পুরাতন খাতার হিসাব শৈষ করে নতুনখাতা খুলতেন। ক্রেতারা এদিন তাদের বাকি খাতা গুছিয়ে নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। হালখাতা উপলক্ষে দোকানি ক্রেতাকে মিষ্টিমুখ করাতেন। হালখাতা উপলক্ষে লাল নীল কাগজের ঝালর কেটে দোকান সাজানো হতো দৃষ্টিনন্দন করে। এদিন ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কটা যেন আরও কাছাকাছি চলে আসতো। কোনো কোনো এলাকায় হালখাতা উপলক্ষে আয়োজন করা হতো বাউলগানের। গভীর রাত পর্যন্ত গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে এই হালখাতা শেষ হতো।
এমনি কত ধরনের অনুষ্ঠান যে ছিল পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে তা বলে শেষ করা যাবে না। যে আয়োজনগুলোর কথা বলেছি তার অনেকগুলি আমি দেখেছি, আবার অনেকগুলির গল্প শুনেছি। আমাদের প্রজন্মের আগেই তা হারিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে এসে পহেলা বৈশাখ বিস্তৃতি পে য়েছে অনেক, কিন্তু এর অনেক আয়োজনগুলোর সাথেই পরিচিত নন আমাদের বর্তমান প্রজন্ম। কিছু আয়োজনের কথা ছোট্ট সোনামণিদের কাছে রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। আমার মা-বাবা, দাদা-দাদি যখন এমন অনেক কথা বলতেন, আমার কাছেও তেমন গল্পের মতো মনে হতো। বর্তমান সময়ে আমাদের সোনামণিদের কাছেও তেমন মনে হয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী আয়োজনগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। পরবর্তীকালে যেন এই ঐতিহ্যকে তারাও লালন করতে পারে।