সাতক্ষীরায় সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় বাড়তি জোয়ার
আজ বৃষ্টি হবে বিক্ষিপ্তভাবে, কাল থেকে আবারো রোদ
ভূঁইয়া নজরুল :
সাত দিনের শক্তি অপচয় হলো চার ঘণ্টায়। গত ১৪ মে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি, ১৫ মে নিম্নচাপ ও ১৬ মে গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্টি হওয়ার পর ১৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। একসময় ঘন্টায় ২৬৫ কিলোমিটার গতিবেগ তৈরি করে ১৮ মে সুপার সাইক্লোনের তকমা লাগালেও একদিন পরেই ১৯ মে এর গতিবেগ কমে যায়। তারপরও ৭০০ কিলোমিটার ব্যাসের শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাতের সময় এর সর্বোচ্চ গতি হয় ১৫১ কিলোমিটার। যদিও এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে বিকাল চারটায় প্রবেশের পর বাংলাদেশে প্রবেশের পর রাত ৯টায় সাতক্ষীরায় রেকর্ড হয় সর্বোচ্চ এই গতি। পরবর্তীতে তা স’ল নিম্নচাপ হয়ে সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী হয়ে ভারতের দিকে অগ্রসর হয়ে রাতে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা। আজ বৃহস্পতিবার দিনভর দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত ঘটাবে ও কাল থেকে দেখা যাবে রৌদ্রকোজ্জ্বল দিন।
সর্বোচ্চ কতো গতিতে আঘাত করে ‘আম্পান ?
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল চারটা পর্যনত্ম ৩২ থেকে ৩৪ পর্যনত্ম বিশেষ বুলেটিনে ঘূর্ণিঝড়র কেন্দ্রের ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার থেকে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। পরবর্তীতে বিকাল চারটার ৩৫ নম্বর বুলেটিনে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের বাতাসের একটানা গতিবেগ ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার রয়েছে বলে উলেস্নখ করা হয়। কিন’ বিকাল চারটায় ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া দিয়ে স’লভাগে প্রবেশ করে আম্পানের চোখ। ঘূর্ণিঝড়ের চোখের ডান দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কোলকাতা ও বাংলাদেশের সুন্দরবন সাতক্ষীরা এলাকায় এর অগ্রভাগ অতিক্রম করে। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র কোলকাতা থেকে রাত ৯টায় যখন বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় অবস্থান করে তখন এর গতিবেগ রেকর্ড হয় ১৫১ কিলোমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ঢাকা প্রধান কার্যালয়ে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশে কত গতিবেগে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। এর জবাবে কর্তব্যরত পূর্বাভাস কর্মকর্তা ও সহকারী আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ উপকূলে সবচেয়ে বেশি বাতাস রেকর্ড হয় রাত ৯টায় সাতক্ষীরায়। তখন এর গতিবেগ রেকর্ড হয় ঘন্টায় ১৫১ কিলোমিটার।
গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় তিনি বলেন, এটি এখন সাতক্ষীরার উত্তরে অবস্থান করছে। এটি ধীরে ধীরে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কুষ্টিয়া ও যশোর হয়ে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে দুর্বল হয়ে যাবে ঝড়টি।
কাল বৃহস্পতিবার কি বৃষ্টি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিড়্গিপ্তভাবে বৃষ্টিপাত হলেও শুক্রবার থেকে রৌদ্রকোজ্জ্বল আবহাওয়া দেখা যাবে।
উপকূলে ছিল বাড়তি জোয়ার
ঢাকা কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ উপকূলে বিকাল চারটার পর থেকে শুরম্ন হয় ঘূর্ণিঝড়ের বর্ধিতাংশ অংশের আঘাত। যদিও কেন্দ্র প্রবেশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে কিন’ এর বিশাল পরিধি ছিল। সেই পরিধির অংশগুলো আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রম করতে চার ঘন্টা সময় লেগেছে। এসময় উপকূলীয় এলাকায় বাড়তি জোয়ার হয়েছে।
একই মনত্মব্য করেন আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন,ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের সময় উপকূলীয় এলাকায় যেমন বড়তি জোয়ার ছিল তেমনিভাবে রাত ১০টার পর আবারো বাড়তি জোয়ার দেখা যায়। অমাবশ্যার কারণে এখন সাগরে স্বাভাবিকভাবেই জোয়ার বেশি, সেই সাথে রাতে জোয়ারের সময়ে বাড়তি জোয়ার হওয়াটা স্বাভাবিক।
যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের পূর্বাভাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লড়্গীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং এসব এলাকার পাশ্ববর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে স্বাভাবিকের চাইতে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল।
অবসান হলো মহাবিপদ সংকেতের
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে গত ১৭ মে দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর জন্য চার নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত জারির পর ১৮ মে মোংলা ও পায়রায় সাত নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করে। ১৯ মে দিনভর একই সতর্ক সংকেত ছিল। পরবর্তীতে গতকাল ২০ মে বুধবার সকাল ৬টায় মোংলা ও পায়রার জন্য ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জন্য ৬ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সকাল ৯টায় আবার সংকেত পরিবর্তন করা হয়, তখন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সংকেত বাড়িয়ে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করে। একইসাথে বহাল রাখা হয় মোংলা ও পায়রার জন্য দেখানো ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত।
তিনবার দিক পরিবর্তন করে ‘আম্পান’
১৮ মে মধ্যরাতের পর এটি একটু পূর্ব দিকে টার্ন নেয়। টার্ন নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে ( বাংলাদেশ উপকূলের দিকে) অগ্রসর হওয়ার পর ১৯মে রাত ৯টায় এটি সোজা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। পরবর্তীতে রাত ১২টার পর এটি আবারো উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলের জন্য ভয় কাজ করে। কিন’ গতকাল ২০মে ভোর তিনটার পর থেকে এটি সোজা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকে অগ্রসর হয়। শেষ পর্যনত্ম এই গতিপথ অনুসরন করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত করে উপকূলে উঠে যায়। এর আগে ভারতের ভুবনেশ্বর ও বালেশ্বর এলাকায় বাম অংশ দিয়ে আঘাত করে।
চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো ক্ষতি হয়নি
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকলেও এখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। চট্টগ্রামের বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ কতো ছিল জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ ফরিদ আহমেদ বলেন,‘ বিকাল চারটার দিকে আচমকা একটা ঝড়ো বাতাস আসে। এক মিনিটের জন্য স্থায়ী সেই বাতাসের গতিবেগ রেকর্ড হয় ঘন্টায় ৩৫ কিলোমিটার। পরবর্র্তীতে রাত পর্যনত্ম বাতাসের গতিবেগ ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
উলেস্নখ্য, পূর্ব মধ্যবঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি ঘূর্ণিঝড় প্রথমে খুব শক্তিশালী ছিল। পরবর্তীতে তা গতি হারিয়েছে। একসময় এর গতিবেগ ২৬০ কিলোমিটার পর্যনত্ম ছিল, এখন এর গতিবেগ কমে ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার হয়েছে। তবে উপকূলে আঘাতের পর আরো কমে যায়।