পরিবর্তন আসছে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থায়

সুপ্রভাত ডেস্ক »

সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থার নাম বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ)। এটি পরিবর্তন করে সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (জিপিএমএস) করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত এই কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধীন দপ্তর ও সংস্থা পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে প্রতি অর্থবছরে কর্মসম্পাদন পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদনের পর মন্ত্রণালয় বা বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে। প্রতি বছরের শেষে দিতে হবে প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে করা হবে মূল্যায়ন।

বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) কাঠামো পুনর্গঠন ও সংস্কার সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ জিপিএমএসের বিষয়ে মতামত জানাতে গত ২৪ জুলাই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে মন্ত্রণালয়/বিভাগ পর্যায়ে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়, যা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বা অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্ট (এপিএ) নামে পরিচিত। পরে এপিএ ধাপে ধাপে উপজেলা পর্যায়ের অফিস পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়।

এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এবং সরকারের সংস্কার ও জনসেবার অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে সরকারি কার্যক্রম অধিক দক্ষ, জবাবদিহিমূলক, জনকল্যাণমুখী, কার্যকর ও গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, যা এপিএতে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদ্যমান এপিএ কাঠামো অধিকতর বাস্তবমুখী ও সহজ করার লক্ষ্যে এর মাপকাঠিগুলো পরিমার্জন ও সংশোধন করে একটি নতুন কাঠামো প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এর ফলে সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডের গুণগত মানোন্নয়ন ও গতিশীল করার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও অংশীজন কর্তৃক মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে গত ১২ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টাকে আহ্বায়ক করে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের আলোকে এপিএ কাঠামো পুনর্গঠন সংক্রান্ত’ একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে এপিএ কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য সুপারিশ দেওয়ার লক্ষ্যে উপকমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গত ১৮ মার্চ ১০ সদস্য বিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়।

গত ২১ মে এপিএ পুনর্গঠন সংক্রান্ত কমিটির সভায় সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনার খসড়া প্রতিবেদন সংশোধন ও চূড়ান্ত করা হয়। খসড়া প্রতিবেদনে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থার নাম বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি/অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্টের (এপিএ) পরিবর্তে সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি/গভর্নেন্স পারফরম্যান্স মনিটরিং সিস্টেম (জিপিএমএস) নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত জিপিএমএস কাঠামো সংক্রান্ত সুপারিশের সেকশন-১ এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও এর অধীন দপ্তর/সংস্থাগুলো একটি বাস্তবসম্মত অভীষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক পাঁচ বছর মেয়াদি আবর্তক পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। প্রতি পাঁচ বছরের শুরুতে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে এ পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। মন্ত্রণালয়/বিভাগ, দপ্তর/সংস্থার জিপিএমএস টিম এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে আবর্তক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পরিকল্পনার সঙ্গে প্রদেয় সব সেবার তালিকা সন্নিবেশ করতে হবে। যার ২০ শতাংশ প্রতি বছর মূল্যায়নের আওতায় আসবে। এই আবর্তক পরিকল্পনা প্রণয়নের সুবিধার্থে মতবিনিময় সভা, কর্মশালা, সেমিনার আয়োজনের জন্য বাজেটে অর্থের সংস্থান রাখতে হবে।

প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অধীন দপ্তর/সংস্থাগুলো পাঁচ বছর মেয়াদি আবর্তক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের উপদেষ্টা/মন্ত্রী থেকে অনুমোদন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আওতায় গঠিত ন্যাশনাল গভর্ন্যান্স পারফরম্যান্স মনিটরিং সিস্টেম এক্সপার্ট পুল (এনজিইপি) কমিটি এই পাঁচ বছর মেয়াদি আবর্তক পরিকল্পনা যাচাই করবে। প্রতি পাঁচ বছরের শুরুতে বিশেষজ্ঞ কমিটি থেকে যাচাই করা আবর্তক পরিকল্পনা উপদেষ্টা পরিষদ/মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে আবর্তক পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রতি বছর প্রয়োজনীয় সংশোধন বা পরিমার্জন করা যাবে, তবে কখনোই তা মূল পরিকল্পনার ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। তবে, বিশেষ বাস্তবতায় এই সীমা মন্ত্রণালয়/বিভাগের উপদেষ্টা বা মন্ত্রীর অনুমোদনের পর উপদেষ্টা পরিষদ বা মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনক্রমে সংশোধন করা যাবে।

সেকশন-২ এ বলা হয়েছে, প্রণীত পাঁচ বছর মেয়াদি আবর্তক পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে প্রতি অর্থবছরে কর্মসম্পাদন পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। প্রস্তুত করা কর্মসম্পাদন পরিকল্পনা অর্থবছর শুরুর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যাচাই করে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করবে। এ কমিটি থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়/বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে।

এতে বলা হয়, সরকারি কার্যক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা প্রদান এবং সেবা প্রদানের মানোন্নয়নের জন্য যথাযথ নীতি ও সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা। তবে, সেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারি সম্পদের সাশ্রয় করা অপরিহার্য। সম্পদের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে চারটি কর্মসম্পাদন ক্ষেত্রের ভিত্তিতে কর্মসম্পাদন পরিকল্পনার কার্যক্রম ও ফলাফল নির্দেশকগুলো নির্ধারণ করা হবে। সেগুলো হলো– ১. সেবা প্রদান, ২. নীতি ও সংস্কার কার্যক্রম, ৩. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা, ৪. উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট ও অন্যান্য কার্যক্রম।

সেকশন-৩ এ বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এর অধীন দপ্তর/সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের গুণগত মানোন্নয়ন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বছর শেষে দাখিল করতে হবে। এ প্রতিবেদন ন্যূনতম দুই হাজার শব্দের মধ্যে হতে হবে। প্রতিবেদন মূল্যায়নের আওতায় আসবে। সে লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রত্যেক সেক্টর ভিত্তিক এক বা একাধিক তৃতীয় পক্ষ মূল্যায়ন টিম গঠন করবে। সরকারি কর্মসম্পাদন পরিমাপ পদ্ধতির সর্বমোট মান থাকবে ১০০%।

নম্বর বিভাজনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সেকশন-১ : পাঁচ বছর মেয়াদি আবর্তক পরিকল্পনার মান- ১০, সেকশন-২ : বিবেচ্য বছরের কর্মসম্পাদন পরিকল্পনার মান- ৮০, সেকশন-৩ : মন্ত্রণালয়/বিভাগের কৌশলগত বিষয় সংক্রান্ত প্রতিবেদনের মান- ১০।

মূল্যায়ন-সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোর জিপিএমএস মূল্যায়ন করা হবে। মন্ত্রণালয়/বিভাগের অধীন দপ্তর/সংস্থা/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মসম্পাদন মূল্যায়ন করবে মন্ত্রণালয়। আর মাঠ পর্যায় ও এর অধীন কার্যালয়গুলোর কর্মসম্পাদন মূল্যায়ন করবে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

উল্লেখ্য, আগামী এক বছর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কাজ করবে, সেই কাজের একটি অঙ্গীকারনামা হচ্ছে এপিএ বা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। বছর শেষে মূল্যায়ন হয় এ চুক্তির। চুক্তি অনুযায়ী বাস্তবায়ন পরিস্থিতি বিবেচনা করে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নম্বর দিয়ে থাকে। এপিএ বাস্তবায়নে সেরা ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সম্মাননা দেওয়া হয়।

২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ এপিএ সই করছে। পরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়/বিভাগের সঙ্গে অধীন দপ্তর/সংস্থার এপিএ সই শুরু হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিভাগীয়, আঞ্চলিক এবং জেলা পর্যায়ের অফিসগুলো এপিএর আওতায় আনা হয়। সর্বশেষে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উপজেলা পর্যায়ের অফিসে এপিএ সম্প্রসারিত হয়।