পরিচ্ছন্ন জাতি গঠনে শুরুটা হোক শিশুদের মাধ্যমে

হোসেন সবেদ »

পরিস্কার পরিছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মেই পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা সুস্থতার পূর্বশর্ত। আর একটি পরিছন্ন জাতি গঠনে প্রয়োজন এ সুস্থ মানুষ। নগরজীবন ব্যবস্থায় নগর এলাকার সার্বিক পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় রয়েছে সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভা। গ্রামীণ এলাকায় এ ধরনের কোন কর্তৃপক্ষ নেই। সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভার অন্যতম দায়িত্ব হল তার দায়িত্বাধীন এলাকার সার্বিক পরিস্কার পরিছন্নতা রক্ষা করা এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামত করা। তবে এর বাইরেও রয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভা গুলোতে রয়েছে পরিছন্নতা কর্মী। নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নিয়ে নিত্য পরিচ্ছন্নতা রক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের এখন সেবক বলা হয়। এ সেবক নাম টি সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরেশন কর্তক ব্যবহৃত হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়। এটা খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যারা মানুষের সেবা করে তাদের কে সেবক বলাটাই শ্রেয়। যদিও তারা নির্ধারিত বেতন বা অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন, তথাপিও তাদের কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় তাদেরকে সেবক হিসেবেই হৃদয়ে স্থান দিতে চাই। ঢাকা বা চট্টগাম মহানগর এলাকার পরিচ্ছন্না নিয়ে আলোচনা করা যাক। ঢাকা মহানগর এলাকায় জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। আর এ আড়াই কোটি লোকের মধ্যে মাত্র এক কোটি লোক প্রতিদিন মাত্র এক টুকরা কাগজ, টিস্যু বা যেকোন একটা ময়লা বা রাস্তাঘাটে বা বাসা বাড়ীর বাইরে ফেলে দিলে তা অপসারণে কত সংখ্যক সেবক প্রয়োজন তা হিসাব করা খুবই কঠিন কাজ। আর এ কঠিন কাজটি করে যাচ্ছেন গুটিকতক সেবক। যদি এ এক কোটি লোক কোন ময়লা না ফেলত তাহলে শহরটা কতই না সুন্দর হত। বিদ্যমান সেবক গন তখন শহরটার অধিকতর শ্রীবৃদ্ধির জন্য কাজ করতে পারত। চট্টগাম মহানগর এলাকায় বসবাসরত প্রায় আশি লক্ষ লোকের ক্ষেত্রে এ একই চিত্র। রাস্তাঘাট হতে শুরু করে ড্রেন, খাল, দুটি ভবনের মধ্যবর্তী স্থান, খোলা জায়গা কোথায় নেই ময়লার ভাগাড়। আমাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থা এ ময়লার কারণে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর এ ময়লা পরিষ্কারে খরচ হচ্ছে রাষ্টের বিপুল পরিমান অর্থ। অথচ এ ময়লাই হতে পারে অর্থনীতির নতুন একটি খাত। পৃথিবীতে কোন কিছুই ফেলনা নয়। আপাত দৃষ্টিতে ক্ষতিকর অনেক কিছুই প্রকান্তরে আমাদের বড় উপকারে আসে। শুধু প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা।

‘এখন শুরুটা হতে হবে শিশুদের থেকে’ বিষয়টি আলোচনা করা প্রয়োজন। শিশুদের একবার একটা নতুন কিছু শেখাতে পারলে তা তাদের মননে স্থায়ী রুপ নেয়। তাদের কে আর নতুন করে বাধ্য করার প্রয়োজন হয় না। এখন কথা হল এ শিশুদের কারা শেখাবে? বাবা, মা বা পরিবারের অন্য কোন সদস্য ? না। কারণ বেশিরভাগ পরিবারের এ সদস্যরাই তো যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে। তবে কিছু মা বাবা কে তো দায়িত্ব নিতেই হবে। আর তারা হল শিক্ষক। দেশের প্রাইমারী এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল স্কুল, মাদ্রাসা ও সমমানের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কে টার্গেট করে সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এখন সরকার বলতে সরকারের কোন সংস্থা করবে? আমি মনে করি এ দায়িত্ব প্রত্যেকটি সিটিকর্পোরেশন এবং পৌরসভার নিতে হবে। সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে হাজার কোটি টাকার কোন বিলাসী প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু সঠিক পরিকল্পনা, নেতৃত্ব এবং প্রত্যেকটি সিটিকর্পোরেশন এবং পৌরসভার দৈনন্দিন পরিছন্নতা কাজে বাড়তি কিছু বাজেট। আর এ বাড়তি খরচের বিষয়টি হবে একটি উত্তম বিনিয়োগ যা ভবিষ্যতে এ খাতের খরচ কে কমিয়ে দিবে অনেকগুন। সকল স্কুল, মাদ্রাসা ও সমমানের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষা প্রতিষ্টানে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলার নিয়ম চালু করতে হবে। এখন ময়লা রাখার পাত্র ক্রয়ের টাকা আসবে কোথা থেকে ? গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে ছাত্ররা হাতের কাজ হিসেবে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে থাকে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবারে বিদ্যমান বাঁশ, বাঁশের শাখা বা কাঠ দ্বারা ময়লা রাখার পাত্র সহজেই তৈরী করা যায়। তবে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রামের মত সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ছাত্র ছাত্রীদের সমন্বয়ে টিম তৈরি করে অনেক সদস্য মিলে এক একটি ময়লা রাখার পাত্র ক্রয় করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ছাত্রদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানেরও একই দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাসেম্বলীতে এবং শ্রেণী কক্ষে শিক্ষক গন ছাত্র ছাত্রীদের নির্দিষ্ট পাত্রে ময়লা ফেলার বিষয়ে অনুশাসন বা অনুরোধ করবেন। প্রত্যেক শ্রেণী থেকে একজন ছাত্র এবং একজন ছাত্রীকে পর্যায়ক্রমে এক মাসের জন্য নির্দিষ্ট পাত্রে ময়লা ফেলার বিষয়ে তদারকির জন্য দায়িত্ব দিতে হবে। অবশ্যই প্রতিমাসের জন্য একজন শিক্ষক কে দায়িত্ব দিতে হবে বিষয়টি দেখভাল করার জন্য। এভাবে কিছু মাসের মধ্যে ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক ও অন্যান্য সকলেই নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। এখানে প্রধান উদ্দেশ্য হল একটা পর্যায় থেকে শুরু করা। আর এ পর্যায়টা হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাত্র ছাত্রীরাই তারা তাদের বাসা বাড়ীতে একই ব্যবস্থা চালু করে ফেলবে। তার পরবর্তীতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যাবে এবং তাদের এ বিষয়ে আর নতুন করে শেখাতে হবে না। আর এরপরই কর্ম জীবনে তারাই হবে দেশের কান্ডারী। ফলে সময়ের পরিক্রমায় এ শুরুটাই একদিন পুরা দেশের দৃশ্যপট একদিন বদলে যাবে। এ প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ অর্থাৎ একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হলেও একটি জাতির সামগ্রিক স্থায়ী এবং টেকসই পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব।

তবে এ দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের সাথে দৈনন্দিন এবং স্বল্প মেয়াদী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। কিছু কার্যক্রম সরকারিসহ অন্যান্য সকল সংস্থা একত্রে উদ্যোগ নিলে দ্রুত ফলাফল পাওয়া সম্ভব। কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা হয় যে প্রতিষ্ঠানের সমুদয় কম্পাউন্ড পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলতে হবে। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে সকল সংস্থা সঠিকভাবে করবে না বা করলেও এক্ষেত্রে সফলতা পেতে সময় লাগবে। সময় লাগতেই পারে। আমাদের তো শুরুটা করতে হবে। কোন কাজ শুরুই যদি না হয়, তাহলে সফলতার বা শেষ হবার তো কোন সুযোগ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এ উদ্যোগ চলাকালে যত সেবা প্রার্থী এ সব প্রতিষ্ঠানে যাবেন তারা সকলে সেখানকার নিয়ম মানতে বাধ্য হবেন বা তারা সেখান থেকে শিক্ষা নিবেন।

এখন আসা যাক আইন প্রয়োগের বিষয়ে। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা শধুমাত্র ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করেই যাবে তা কী করে হয় ? আমি মনে করি জরিমানা বা ফাইনের ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। অবশ্য জরিমানার কথা শুনলে সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি গন ভয় পেতে পারেন যে, জরিমানা চালু করলে জনগন পরবর্তীতে তাদের আর ভোট দিবেন না। তবে এ কাজটিও করেতে হবে ক্রমান্বয়ে এবং সহনীয়ভাবে। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে ০৬ মাস শুধুমাত্র লিখিত সতর্ককরণ কাজ চালিয়ে যেতে হবে এবং তা মিডিয়াতে প্রচার করতে হবে। অর্থাৎ অভিযানকালে মিডিয়ার লোক সাথে রেখে বা ভিডিও ধারন করে তা পরবর্তীতে মিডিয়াতে প্রচার করা যেতে পারে। ০৬ মাস পর স¦ল্প পরিমানে জরিমানা শুরু করতে হবে। একজন ড্রেনে বা খালে বা রাস্তায় ময়লা আবর্জনা ফেলল, তাকে প্রথমবারের মত মাত্র ২০ টাকা ৫০ টাকা জরিমানা করা হল এবং বিষয়টি মিডিয়াতে প্রচার করা হল। এভাবে সময়ের সাথে সাথে জরিমানা বাড়িয়ে ১০০ টাকা বা ১৫০ টাকা বা যৌক্তিক একটা পরিমান নির্ধারণ করা যাবে। এখানে জরিমানার পরিমান সবক্ষেত্রে মূখ্য নয়। একটি দুটি ক্ষেত্রে জরিমানা করে সফলতা পাওয়ার বড় উদাহরন এ বাংলায়ই রয়েছে। পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা শুরু হয়েছিল মাত্র ৫০ টাকা। এটা শুরুর নির্দিষ্ট দিন তারিখ মনে নেই। তবে কমপক্ষে ২০ (বিশ) বছর পূর্বে এ জরিমানার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং মিডিয়াতে বহুল প্রচারিত হয়। এর ফলাফল আমরা আজ ভোগ করছি। বিশেষ করে পাবলিক বাস এবং ট্রেনে সাধারণত কেউ ধূমপান করে না। আর একটি উদাহরণ হল গাড়ির ড্রাইভার এবং যাত্রী কর্তৃক সিটবেল্ট বাঁধা এবং মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে হেলমেটের ব্যবহার। বিশেষ করে প্রাইভেট পরিবহনে প্রায় ৮০ ভাগ সফলতা লক্ষ করা যায়। আর মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে শহর পর্যায়ে প্রায় ৯০ ভাগ সফলতা রয়েছে।

সর্বপরি ময়লা আবর্জনাকে পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ করে তা সম্পদে রুপান্তর করতে হবে। এক সময় গার্মেন্টস শিল্পের পরিত্যক্ত কাপড় ফেলে দেয়া হত এবং কার জমিতে ফেলা হল তা নিয়ে বিভিন্ন বিবাদ সৃষ্টি হত। আর এখন সেই গামেন্টসের পরিত্যক্ত কাপড় দিয়ে নানা রকম পন্য যেমন পুতুল, ছোট বাচ্ছাদের পোশাক, গৃহস্থালী বিভিন্ন মালামাল। আর কাপড়ের যে অংশ দিয়ে আর কোন কিছু করার নেই তা দিয়ে তুলা তৈরী করে তোষক, বালিশ, কম্বল ইত্যাদি ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করা হয়। ঠিক একইভাবে ময়লা আবর্জনাকে পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ করে তা সম্পদে রুপান্তর করা সম্ভব। শিশুদের থেকে শুরু করাসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমার এ সোনার দেশের একটি পরিচ্ছন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেতে খুব বেশি বছর অপেক্ষার প্রয়োজন হবে না।

লেখক ও কলামিস্ট