‘টানেলের যে মূল সড়ক কক্সবাজার সড়কের সাথে সংযুক্ত হবে, এটি যদি মাটির ওপর নির্মাণ করা হয় তাহলে এটি তেমন কাজে আসবে না, কর্তৃপক্ষ যদি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে, তাহলে যান চলাচল নির্বিঘ্নে হবে।’
–— সড়ক পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ড. এম শামসুল হক
সংবাদদাতা, আনোয়ারা »
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পর ২৯ অক্টোবর থেকে যান চলাচল শুরু হয়। ভারী শিল্পায়ন ও টানেল হয়ে কক্সবাজারে যে দূরপাল্লার যান চলাচল হবে তার জন্য আনোয়ারা-কর্ণফুলী ও চন্দনাইশ হয়ে নির্মিত হচ্ছে টানেলের মেগা সড়ক। যা সাংহাইয়ের পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত আনোয়ারাসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল।
এদিকে সরকার টানেল নির্মাণের পর গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থানে যাতায়াত সুগম করতে উপজেলার সড়কগুলো আধুনিক ও চওড়া করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ জন্য ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম সড়ক আনোয়ারা যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নতীকরণ’ নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯৫ কোটি ৭৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
প্রস্তাবটি নিয়ে ৮ অক্টোবর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
সভায় প্রকল্প প্রস্তাবনার বেশ কিছু অংশ নিয়েই নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। পিইসি সভায় প্রকল্পটি নিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এগুলো প্রতিপালন করে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করা হলে পরে প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর মঙ্গলবার রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন পেয়েছে চট্টগ্রামের পাঁচটি প্রকল্প। এরমধ্যে ৪টি দক্ষিণ চট্টগ্রামের সড়কখাতে।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে আনোয়ারা উপজেলা সংযোগ সড়কসহ কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, চাতরী-সিইউএফএল-কর্ণফুলী ড্রাইডক-ফকিরহাট জাতীয় মহাসড়ক যথাযথমানে ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় গাছবাড়িয়া থেকে আনোয়ারা পিএবি সড়কের চৌনাপাড়া পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার ও চৌনাপাড়া থেকে শোলকাটা লাবীবা কনভেনশন হল পর্যন্ত ২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়ক নতুন করে নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে লাবিবা কনভেনশন হল থেকে কালাবিবির দীঘির মোড় পর্যন্ত ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার এবং আনোয়ারা ফায়ার স্টেশন থেকে কালাবিবির দীঘির মোড় পর্যন্ত ২ দশমিক ৩৪৫ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কের মতো উন্নয়ন করা হবে।
প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এই সড়কগুলো ১০ দশমিক ৩০ মিটারে উন্নীত করা হবে। এতে করে মহাসড়কগুলোর মান পাবে। আর এই সড়কটি কালাবিবির দীঘির মোড় থেকে গাছবাড়িয়া পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৪২৫ কিলোমিটার সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৯৫০ কিলোমিটার রিজিড (আরসিসি) ইকুপমেন্ট নির্মাণ বাবদ ৩০ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ব্যয় নিয়ে জানতে চাওয়া হয় সভায়। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় তিনটি বাস-বে নির্মাণ (বাস দাঁড়ানোর স্থান) বাবদ ৫৫ লাখ ১৭ হাজার টাকা এবং তিনটি যাত্রী ছাউনি বাবদ ৪৩ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এ ব্যয় নিয়ে বিস্তারিত জানতে চায় পিইসি।
প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) এক হাজার ৬৮০ মিটার আরসিসি ইউ-ড্রেন নির্মাণ বাবদ তিন কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ছয় হাজার মিটার আরসিসি ড্রেন-কাম-ফুটপাত বাবদ ২৬ কোটি ৪১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, চার হাজার ৩৯৫ মিটার আরসিসি রিটের্নিং ওয়াল নির্মাণ বাবদ ৪৫ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ইউটিলিটি শিফটিং বাবদ ১২ কোটি ৫৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এসব ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় পিইসি সভায়। এগুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দিতে বলা হয়েছে।
পিইসি সভায় বলা হয়, যাচাই কমিটির সিদ্ধান্তের জন্য যৌথ জরিপ ও বিস্তারিত বিভাজন ডিপিপিতে থাকা প্রয়োজন। ডিপিপিতে উল্লিখিত মূলোৎপাটন (গাছের শিকড়সহ তোলার খরচ) ও বৃক্ষরোপণ দুটির অনুকূলে ৩৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা ও ৫৭ লাখ ৮৯ হাজার টাকার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও সভায় প্রশ্ন তোলা হয়।
এদিকে টানেলের গতি বাড়াতে এসব সড়কগুলো কী রকম প্রভাব ফেলবে এবং দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক সড়ক পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ড. এম শামসুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, টানেল এটি সাধারণ যান চলাচলের জন্য নয়। এটি যেহেতু শিল্পপায়নের ও সাংহাই সিটির আদলে টার্গেট করে নির্মাণ করা হয়েছে, তাই এতে সাধারণ যানচলাচল তুলনামূলক কম হবে। এখন এই টানেলের কানেক্টিং সড়কগুলো সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী করতে হবে। টানেলের যে মূল সড়ক কক্সবাজার সড়কের সাথে সংযুক্ত হবে এটি যদি মাটির ওপর নির্মাণ করা হয় তাহলে এটি তেমন কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ এটি যদি মাটির ওপর নির্মাণ করা হয় তাহলে পরিবেশের ওপর একটা বড় প্রভাব পড়বে। যানজট নিরসন হবে না এবং এই সড়ক দিয়ে ছোট যান চলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়বে। এটা যেহেতু একটি উপকূলীয় উপজেলা, বন্যার সময় সমস্যা দেখা দেবে। টানেল যেহেতু একটি বড় মেগাপ্রকল্প সেহেতু এই সড়কগুলো এই প্রকল্পের অংশবিশেষ। এগুলো যদি পরিকল্পিত না হয় তাহলে টানেল কার্যত কোন কাজে আসবে না। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে তাহলে দুর্ঘটনা কমবে। যান চলাচল দ্রুত ও নির্বিঘ্ন হবে। শিল্পায়নের ভারী যানগুলো লোকালয়ে কোন প্রভাব ফেলবে না। মূল কথা হচ্ছে টানেল যেভাবে আগামী ১০০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সেই প্ল্যান অনুযায়ী এ সড়কগুলো নির্মাণ করতে হবে। তবেই এ মেগা প্রকল্পের সড়কগুলোর সুফল পাওয়া যাবে।
সদ্য একনেকে পাস হওয়া এসব প্রকল্প নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)’র নির্বাহী প্রকোশলী সুমন সিংহের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। এর মধ্যে একটি প্রকল্পের সিইউএফএল সড়ক সামনে দরপত্র দেওয়া হবে। বাকি প্রকল্পগুলো একনেকে আরও যাচাই-বাছাই হবে। তারপর ক্রমান্বয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হবে।