অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »
শিশুর জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ আলোকিত জীবনের শিখা। শিশুদের যদি স্বাভাবিক বৃদ্ধি না ঘটে তাহলে একটি দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যতœ করলেই রতœ মিলে বলে একটি প্রবাদ আছে। সযতœ পরিচর্যায় জীবনে যেমন অনেক ফল পাওয়া যায়, তেমনি প্রতিভা যদি সঠিকভাবে লালিত হয়, তাহলে তার কাছে উল্লেখযোগ্য ফল প্রত্যাশা করা সম্ভব। যতœ না করলে প্রতিভার অকালমৃত্যু ঘটতে পারে। ফসলের বীজে নিহিত আছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। অনুকূল পরিবেশ না পেলে সে বীজ কোন কাজে আসবে না। প্রতিভা জন্ম নেয়, কিন্তু তাকে লালন করতে হবে, তার বিকাশের পরিবেশ অনুকূল করে দিতে হবে- তবেই তার কাছ থেকে অতুলনীয় অবদান লাভ করা যাবে।
অনুকূল পরিচর্যার সুযোগ না পেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে সকল সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গেছে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। এমন শিশুদের একটা বড় অংশ অভিভাবকহীন পথশিশু। যে সকল শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় বিশেষত অধিকারবঞ্চিত পথশিশু। যাদের মৌলিক ও মানবাধিকার বলে কিছু আছে? দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর অনেকেই এসেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। কাজের অভাবে খেয়ে না খেয়ে তাদের রাত কাটে রাস্তার ধারে বা সরকারি স্থাপনার খোলা বারান্দা বা রেললাইনের পাশে। অভিভাবকহীন এসব শিশুর পথচলা নিজেদের খেয়াল খুশি মত। পথশিশুদের পারিবারিক বন্ধন বলে কিছু নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা তাদের কপালে কখনো জোটে না।
আমাদের দেশের অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়। এসব শিশুই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যে সময়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা সে সময়ে তাদের কুলি, হকার, রিকশাচালক, শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্নœ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়।
পথশিশু হওয়ার পেছনে বিভিন্ন নিয়ামক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন দারিদ্র্য বাবা মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা-মা মারা যাওয়া বা বাবা মায়ের অসচেতনতা অথবা অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে এখন কিছু শিশু পথে দিন কাটায়। ফলে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। পথশিশুদের জীবনযাপন অত্যন্ত দুর্বিষহ। শহরের খোলা আকাশের নিচে, ব্রিজের নিচে, মার্কেট, পার্ক, বাস ও রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান তাদের আশ্রয় কেন্দ্র। বাজার ও নৌ বা বাস টার্মিনাল কেন্দ্রিক তাদের বসবাস। নৌ বা বাস টার্মিনালে তারা রাত-দিন কাজ করে সামান্য টাকা আয় করে। এ টাকা দিয়ে তারা রাস্তার ধারের ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে খায়। আয় না হলে না খেয়েই দিনযাপন করে। এজন্য অধিকাংশ পথশিশু অপুষ্টিতে ভোগে। চর্মরোগ, ডায়রিয়া, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, জন্ডিসসহ নানা রোগে তারা আক্রান্ত হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাবে পথশিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়।
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-১৯৭৪, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা, জোর জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যে সকল কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে।
বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার : ৭বছরের নিচে শিশুর কোন আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহন খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নীচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বে-আইনি।
শিশুদের প্রতি সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাদের কিশোর বয়সেই। এই বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রধানত কিশোরেরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বন্দ্ব সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব পথশিশু জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্মে। একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী আছেন, যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করে। অনেক সময় পথশিশুরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। দারিদ্র্যের কারণে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই নানামুখী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কোনো রকমের অসামাজিক কার্য সম্পাদনের বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসন সহ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। মনে রাখতে হবে সমস্যা অনন্ত কিন্তু সমাধানের উপায়ও যথেষ্ট আছে।
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিশু এবং পথশিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। ঝরে পড়া রোধ করতে হলে প্রথমে সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। প্রতি বছর শেষে কী কী কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। শিশুদের যেন কোনোভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করতে না পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ শিশুবান্ধব সংস্থার উন্নয়নকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের দেশের অনেক ছিন্নমূল শিশু রয়েছে যারা দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না। অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের দিন কাটে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার জোগাতে পারে না। তারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এজন্য এসব শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব শিশুর অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। উন্নত দেশে দেখা যায়, শিশুর সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। তেমনি আমাদের দেশের অবহেলিত শিশুদের সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিলে সমাজে আর কোনো অরাজকতার সৃষ্টি হবে না। মেয়েদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয় বা কলেজে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত হওয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর ওপর নিপীড়নের ঘটনা অভিভাবকদের মনে এক ধরনের আতংক সৃষ্টি করে যা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ।
অপরদিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধের জন্য শিক্ষকগণকে অভিভাবকদের প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে শিক্ষার অভাবে তাদের সন্তানরা কিভাবে পদে পদে শোষণের শিকার হয়। শিক্ষকের যথাযথ ভূমিকা, সহযোগিতা, তত্ত্বাবধান ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব অনেক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিনষ্ট হতে পারে। অপরদিকে একজন শিক্ষকের একটু উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নৈতিক মূল্যবোধের দিকনির্দেশনার ফলে একজন ছাত্রছাত্রী নিজের জীবন গঠন করে শুধু দেশের নয়, সমগ্র মানবতার কল্যাণে অবদান রাখতে পারে।
পরিবার-শিক্ষক সকলকেই সচেতন থাকতে হবেএ অবশেষে বলবো, কম-বেশি প্রতিটি মানুষের মাঝেই মেধা ও প্রতিভা সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। তাকে বিকাশের পথ করে দিতে হবে। বিকাশের প্রয়োজনীয় সুযোগ না পেলে অবহেলায় উপেক্ষায় শক্তি সামর্থ্য বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। নির্জন বনে অনেক সুগন্ধি ফুল ফোটে। শিশুরা হচ্ছে সমাজ নামক বাগানের প্রস্ফূটিত ফুল। এ তাদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : আইনজীবী