নিজস্ব প্রতিবেদক »
সরকারের পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের হুলাইন এলাকায় চলছে এআরএইচ ব্রিকফিল্ড। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২০০ ফুটের মধ্যে অবস্থানের কারণে ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে ইটভাটাটি বন্ধ করেছিল। কিন্তু পুনরায় সেটি চালু করা হয়েছে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া; ফলে মিলেনি লাইসেন্স।
সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালান পটিয়া উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা। ২০১৩ সালের পরিবেশ আইনের ৪ ধারা লঙ্ঘনের অপরাধে ১৪ ধারায় এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। এরপরও ইটভাটায় কৃষি জমির মাটি ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে ইট। এছাড়া আবাদি জমির টপ সয়েল দেখা গেছে। সেই মাটির উৎস্য সম্পর্কে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি বলে উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে। তবে মালিকপক্ষ বলছে, প্রশাসনের জ্ঞাতসাওেন তারা অবৈধভাবে ইটভাটা চালাচ্ছেন।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের (২০১৩) ধারা-৪ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। একই আইনের ধারা (৮) এর (১) অনুযায়ী লাইসেন্স থাকলেও লোকালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপনের সুযোগ নেই। ধারা-৫ এর (১) অনুযায়ী- কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলার মাটি কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ধারা-৬ এ বলা হয়েছে- ইট পোড়ানোর কাজে কাঠ ব্যবহার নিষেধ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ ছাড়পত্র ও অন্যান্য ডকুমেন্টসহ আবেদনের পর লাইসেন্স দেওয়া হয়। এআরএইচ ব্রিক ফিল্ড লাইসেন্সের জন্য একটি আবেদন দিয়েছে। কিন্তু এরপর কোন ধরনের যোগাযোগ করেনি। মালিকপক্ষকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে একাধিকবার বলা হলেও পাত্তা দেয়নি। লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধভাবে ইট প্রস্তুত ও বিক্রি করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পটিয়া হুলাইন ছালেহ নুর ডিগ্রি কলেজ। কলেজের ১০০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যেই এআরএইচ ইটভাটার অবস্থান। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, ধোঁয়ার কারণে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কৃষি জমির মাটি ও বনের কাঠ পোড়ে। পাশের থাকা একটি স’মিল থেকে কাঠ যায়। বন বিভাগ জানিয়েছে স’মিলের লাইসেন্স রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কলেজে ক্লাস চলাকালীন কালো ধোয়ায় নিঃশ্বাস ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারেন না। নানাভাবে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা আলাউদ্দিন ভূঁইয়া জনি জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে অভিযান চালিয়ে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স না থাকা এবং কৃষি জমির মাটি পোড়ানোর কারণে জরিমানা হয়েছিল। শিগগির তিনি আবার পরিদর্শনে যাবেন বলে জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার জানান, পটিয়া উপজেলায় কোন ইটভাটার ছাড়পত্র নেই। অবৈধ ইটভাটা বন্ধের অভিযান চলমান। হুলাইন সালেহ নুর ডিগ্রি কলেজের সামনে এআরএইচ ইটভাটাটি অবৈধ তালিকায় আছে।
পরিবেশবিদ ও সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখিন। টপ সয়েল কাটায় জমির উর্বরতা হারায়, অথচ জমির টপ সয়ের তৈরি হতে ২০ থেকে ২৫ বছর লাগে। কাঠ পোড়ানোর মাধ্যমে সবুজ বন উজাড় হচ্ছে; এতে খরা ও মরুকরণ হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তাপমাত্রা বাড়ার অন্যতম একটি কারণ এই ইটভাটা। এভাবে পরিবেশ ধ্বংস করলে আগামী প্রজন্ম সুন্দর ভবিষ্যৎ পাবে না।
বাংলাদেশে অসম্ভব বলে কিছু নাই:
জানতে চাইলে এআরএইচ ব্রিক ফিল্ডের মালিক সুমন হেলাল উদ্দিন চৌধুরী সুমন জানান, এটা তাদের পারিবারিক ব্যবসা। তাদেরও একটি পত্রিকা আছে। তার চাচাত ভাই চৌধুরী হাসান মাহমুদ আকবরী ওই পত্রিকার বড় পদে আছেন। লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা চালানোর বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে অসম্ভব বলে কিছু নাই। ২০১২ সালের পর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটার ছাড়পত্র দিচ্ছে না; তাহলে সারাদেশে কিভাবে চলছে? ডিসি অফিসের সঙ্গে একটা সিস্টেমে চলতেছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি জরিমানার বিষয়ে বলেন, সরকারের ফান্ড ক্রাইসিস দেখা দিলে এ ধরনের জরিমানা করে। আইন অনুযায়ী লোকালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের বিষয়ে বলেন, ১৯৮৮ সালে ইটভাটার লাইসেন্স নিয়েছি; রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবানেও আমাদের ইটভাটা আছে। তারা সবকিছু দেখেই লাইসেন্স দিয়েছে, সেটার সাফারার কী আমি হব?
স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাটার কয়েক’শ ফুট উত্তরে জনতা স’মিল। সেটির মালিক চৌধুরী হাসান মাহমুদ আকবরী। সেখানে অবৈধভাবে বনের গাছ চিরানো হয় এবং অবৈধভাবে কাঠ পাচার হয়। ওই স’মিল থেকেই গোপনে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর জন্য নেওয়া হয়। মূলত পত্রিকার প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। চৌধুরী হাসান মাহমুদ আবকরীর মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠালেও কোন সাড়া দেননি।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘনে শাস্তি:
ধারা ৪-এ ভঙ্গের শাস্তিতে বলা হয়েছে- ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৪ লঙ্ঘন করিয়া কোনো ইট প্রস্তুত বা ইটভাটা স্থাপন, পরিচালনা বা চালু রাখেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসরের কারাদ- বা অন্যূন ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।’
ধারা-৫ এর (১) লঙ্ঘনের শাস্তি অনধিক ২ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৫ লাখ টাকা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ধারা-৬ লঙ্ঘনে তিন ঊয়রের কারাদ- বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিতের বিধান রয়েছে।
ধারা (৮) এর উপধারা (১) এ বলা হয়েছে- ‘বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক, এই আইন কার্যকর হইবার পর আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যেক এলাকা, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষি জমি; বিশেষ কোন স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বা অনুরূপ কোন স্থান বা প্রতিষ্ঠান হইতে কমপক্ষে ১ (এক) কিলোমিটার দূরত্বের সীমানার অভ্যন্তরে কোন ব্যক্তি কোন ইটভাটা স্থাপন করিতে পারিবেন না।’ ৮ এর উপ-ধারা (১) এর লংঘনে অনধিক ৫ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।