অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »
বিচারকার্য ত্বরান্বিত ও প্রসারিত করার উদ্দেশ্যেই সাক্ষ্য আইনের সৃষ্টি। গণতান্ত্রিক দেশে বিচার বিভাগের দায়িত্ব যদি ঠিক ভাবে পালন করতে হয়, তাহলে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। সাক্ষ্য হচ্ছে আদালত কর্তৃক কোন বিচারকার্য সম্পাদনের সময় পক্ষগণ কর্তৃক তাদের সাক্ষীর রেকর্ড বা দলিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে আদালতের মনে বিশ^াস স্থাপনের প্রয়াসে আইন সঙ্গতভাবে উপস্থাপিত প্রমাণের কোন নমুনা। প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়েই অপরাধীকে সাজা দেওয়া সম্ভব হয়।
কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন বলে খবর আসে। সাক্ষী অনুপস্থিত থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে আসামিপক্ষ থেকে সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানোসহ জীবননাশের হুমকির কথা বলে থাকে। এমনকি সাক্ষীর জীবননাশের ঘটনাও ঘটেছে। আসামি পক্ষের হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদানসহ নানা কারণে সাক্ষীরা হাজির হয়না।
এছাড়া কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় যথাসময়ে সমন না পৌঁছায় হাজির হতে পারেন না অনেক অফিসিয়াল সাক্ষী। আবার সমন পেয়েও সাক্ষ্য দিতে অনীহা বোধ করেন কেউ কেউ। অন্যদিকে সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে অনেক ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না, পাশাপাশি বিলম্বিত হয় বিচার কার্যক্রমও। এমনকি মামলার আসামিরা খালাস পর্যন্ত পেয়ে যায়। সাক্ষীর যথাযথ নিরাপত্তা ও সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নষ্ট হয়ে বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হচ্ছে এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বারবার সমন দিয়েও সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ মামলার বিচার।
ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮ ও দ-বিধি, ১৮৬০ সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন বিষয় প্রদান করা হয়নি। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ কেবল সাক্ষ্য আইনের ১৫১ ও ১৫২ ধারায় কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যা সাক্ষীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে সক্ষম না। দেশে প্রচলিত অন্যান্য সকল আইনের ন্যায় সাক্ষ্য আইন একটি সংবিধিবদ্ধ দলিল, এর উপর ভিত্তি করে বিচারকার্য পরিচালিত হয় । বিচারককে সুনিশ্চিত করার জন্য সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়। বিচার কার্যের উদ্দেশ্য হল সত্য প্রতিষ্ঠা করা। সত্য অন্বেষণের স্বার্থেই সাক্ষ্য আইনের প্রয়োজন। দেশে প্রচলিত দেওয়ানি, ফৌজদারি আইন এবং সংবিধানের শব্দ ও বাক্যের সঠিক উদ্ধারের ও ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে সাক্ষ্য আইনকে কার্যকরী করা হয়।
১৮৭২ সালে আদালতসমূহে সর্বপ্রথম সাক্ষ্য আইনের উদ্ভব ঘটে। সাক্ষ্য আইনের মূল উপাদান হল সাক্ষী । ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের বিধান মতে, প্রত্যেক মামলায় উহার বিচার্য় বিষয় প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাই উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর বিচারক বিচার্য বিষয় স্থির করেন। স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট মামলার পক্ষগণ তাদের ইচ্ছামত কোন সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে না। যেহেতু সাক্ষ্যদান কালিন তাদেরকে সাক্ষ্য আইনের বিধিবদ্ধ বিধান মেনে চলতে হয়। বস্তুতপক্ষে সাক্ষ্যের উদেশ্য হল আইনানুগ সাক্ষ্য প্রদান গ্রহণ করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে পক্ষগনের দায়দায়িত্ব, দেনা বা অধিকারসমূহের নিশ্চয়তা দান করে। মামলা নিম্পত্তি তথা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সাক্ষ্যের ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মামলা নিষ্পত্তির মূল ভিত্তি হল সাক্ষ্য। সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। সাক্ষ্য আইনের ১৩২ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে কোন প্রশ্নোত্তর সাক্ষীকে অপরাধ মুক্ত করবে কিংবা উত্তর দিলে তার সাজা হতে পারে এ অজুহাতে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তবে এরূপ প্রশ্নের উত্তরের ফলে তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। অথবা সমস্যা করা যাবে না অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ছাড়া অন্য কোন ফৌজদারি মামলায়ও তাকে জড়িত করা যাবে না। অবশ্য সাক্ষ্য আইনের এই বিধান ব্রিটিশ সাক্ষ্য আইনের সাথে বিরোধীয়। কারণ ব্রিটিশ সাক্ষ্য আইনে অপরাধের সাথে সংযুক্ত হতে পারে কিংবা ফৌজদারি মামলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে এরূপ প্রশ্নোত্তর দিতে সাক্ষী বাধ্য নহে।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে দোষী ব্যক্তিদের বিচারকালীন নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচের কথা বলা আছে। এখানেও সংক্ষুব্ধ বা সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ২০১১ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আইন কমিশন এ প্রস্তাব এনেছে। প্রস্তাবটি বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে তৈরি করা হয়।
জাতিসংঘের ১৯৮৫ সালের সনদটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন (টঘ ফবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ নধংরপ ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ লঁংঃরপব ভড়ৎ ারপঃরসং ড়ভ পৎরসব ধহফ ধনঁংব ড়ভ ঢ়ড়বিৎ) নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩, মানব পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩। এই আইনসমূহে ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে। সরকার ২০১১ সালে ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ শিরোনামে আইনটি তৈরির উদ্যোগ নেয় এবং জাতীয় আইন কমিশন এ সংক্রান্ত আইন তৈরির খসড়া পাঠায়।
২০০৬ সালে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা আইনের খসড়া উপস্থাপন করেন এবং ২০১১ সালে উক্ত আইন প্রয়োগে বিস্তারিত সুপারিশ হিসাবে ১৯ দফা সুপারিশ করলেও অদ্যাবধি তা আলোর মুখ দেখেনি। কমিশন তাদের সুপারিশমালায় সুরক্ষার অধিকার, সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সুরক্ষা বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন সংস্থা, সুরক্ষা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, আবেদনের শর্তাবলী, সুরক্ষাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) বা সাক্ষীর অধিকার, সাক্ষীদের অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, সাক্ষীর অঙ্গীকার, সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ ১৯টি সুপারিশমালা প্রেরণ করে। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমানো, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সাক্ষীর সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। মামলার অভিযোগ প্রমাণে কষ্টসাধ্য হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে কোন সাক্ষী মামলার সাক্ষ্য দিতে আসবে না। আসামি পক্ষের হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদানসহ নানা কারণে সাক্ষীরা হাজির হয় না। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে মামলা প্রমাণ হয় না। সমন নোটিশ, ওয়ারেন্ট সঠিক ভাবে তামিল না হওয়া, জারি রিপোর্ট যথাসময়ে আদালতে না আসা, সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার কারণে সাক্ষী আদালতে এসে ফিরে যায়। আবার আদালতের পরিবেশের কারণে এবং সাক্ষী সংশ্লিষ্ট মামলার নথি আদালতে উত্থাপন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা/ অবকাশ যাপনের উপযুক্ত জায়গা না থাকায় সাক্ষী চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীকে ব্যক্তিগত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সাক্ষীদের থানায় না ডেকে ঘটনাস্থলে ও তাদের কর্মস্থল বা বাসস্থানে বা আইনজীবীর চেম্বারে সাক্ষ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। সত্যের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি মামলায় কাউকে সাক্ষী করার পূর্বে অবশ্যই সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে কিনা মতামত নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাক্ষীর সুরক্ষায় উন্নত আইন রয়েছে। কোন মামলায় সাক্ষী কেন আসেনি, জানা দরকার।
সাক্ষীরা একটি মামলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যাতে নির্বিঘেœ-নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন এবং তাদের নিরাপত্তা স্বার্থে সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা দরকার। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পরিচয়ের নিরাপত্তা, আর্থিক, চিকিৎসা, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, যোগাযোগ, জনসম্মুখে না যাওয়ার, সাধারণ ও আইনগত অন্যান্য সুবিধা বা নিরাপত্তা এ আইনের আওতায় আসতে হবে। নতুন আইন বা বিদ্যমান আইনে সংযোজন যেভাবেই হোক, এগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
লেখক : আইনজীবী