সনাতন চক্রবর্তী বিজয় »
ফেলে দেওয়া ই-বর্জ্যে বাড়ছে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি। আপনার আশেপাশের ভাঙারির দোকানি চোখ বুলালেই দেখতে পাবেন অসংখ্য ই-বর্জ্য। মজার বিষয় হলো ভাঙারির দোকানি সহ যারা এই ধরনের বর্জ্য নিয়ে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই জানেন না ই-বর্জ্য কি? ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি বোঝায়। এগুলি মূলত ভোক্তার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন- ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার ও শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। অধিকাংশ ভাঙারির দোকানি এসব নষ্ট ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম থেকে ব্যাটারি, সার্কিট, প্লাস্টিকের খোলস ইত্যাদি নিজ হাতে আলাদা করেন। কিছু কিছু আগুনে গলিয়ে ফেলেন। এরপর বিক্রি করেন। এদের অধিকাংশই তাদের দীর্ঘ ব্যবসায়িক জীবনে কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করেননি। ভাঙারির দোকানিদের সাথে সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গেলেই ওনারা হেসে উড়িয়ে দেন। ময়লার সাথে বসবাস আবার সুরক্ষা সামগ্রী! একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন দীর্ঘদিন ধরে যারা সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া এসব কাজ করছেন তাদের অধিকাংশেরই ফুসফুসে নানান সমস্যা ধরা পড়েছে। হাতের চামড়াও কেমন যেন উঠে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের মধ্যে সীসা, সিলিকন, টিন, ক্যাডমিয়াম, পারদ, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি রাসায়নিক থাকে। এসব রাসায়নিক মাটি ও পানিকে নানানভাবে দূষিত করছে। নানাভাবে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, ই-বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের রক্ষা করতে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বে ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। এ সংখ্যক নারী ও তাঁদের অনাগত সন্তানদের বিষাক্ত ই-বর্জ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরের একটা বড় অংশ সক্রিয়ভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত আছে। অভিভাবকেরা প্রায়ই শিশুদের ই-বর্জ্য খেলতে দেন ও পুনঃব্যবহার কাজে লাগান। ই-বর্জ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক, বিশেষ করে মার্কারি এবং সীসা উচ্চমাত্রায় থাকে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ খুব সহজেই শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। এতে শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের ক্ষমতা কমে।
প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদিত হয়। আবার বিপুল পরিমাণ পণ্য ফেলে দেওয়া হয়। এতে পৃথিবীজুড়ে ‘ ই-বর্জ্যের সুনামি’ চলছে। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছে। ২০১৪ সালে জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় “ঞযব এষড়নধষ ঊ-ধিংঃব গড়হরঃড়ৎ ২০১৪: ছঁধহঃরঃরবং, ঋষড়ংি ধহফ জবংড়ঁৎপবং” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে বলা হয় যে, বিশ্বে প্রতিবছর ৪ কোটি টনেরও বেশি ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই দুইটি দেশ সারা বিশ্বের ই-বর্জ্যের এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে। ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১০- ২০১৫ এই ৫ বছরে এশিয়ায় ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। কম্বোডিয়া, চীন ,হংকং, ইন্দোনেশিয়া ,জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ,দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ,থাইল্যান্ড,ও ভিয়েতনাম এই ১২টি দেশে ২০১৫ সাল শেষে এই ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু চীনে পাঁচ বছরে তা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখ ৮১ হাজার টন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের (টঘট) বরাত দিয়ে ২০১৯ সালের ৪ জুন ঞযব এষড়নধষ ঊ-ডধংঃব ঝঃধঃরংঃরপং চধৎঃহবৎংযরঢ় “এষড়নধষ ঊ-ডধংঃব ঢ়ৎড়নষবস” এর উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয় যা এ পর্যন্ত বিশ্বে উৎপাদিত সকল বাণিজ্যিক বিমানের ওজনের চেয়ে বেশি। ২০১৬ সালে বিশ্বে ৪৪.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে । যার মাত্র ২০ শতাংশ রিসাইকেল হয়েছে আর ৬৬ শতাংশ এখনো মানবজাতিকে আচ্ছাদন করে রয়েছে। ঝড়ষারহম ঃযব ঊ-ডধংঃব চৎড়নষবস (ঝঞঊচ) একটি প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বের ৭০০ কোটি জনগণের প্রতিজন গড়ে বছরে ৭ কেজি করে ই-বর্জ্য সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক মেশিনারি মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন (বিইএমএমএ) এর গবেষণা বলছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন টন ইলেকট্রনিক পণ্য সরবরাহ হয়, যার মধ্যে মাত্র ২০-৩০ শতাংশ পণ্য রিসাইক্লিং বা ধ্বংস হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) গবেষণা বলছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ১২ লাখ টনে পরিণত হবে। ই-বর্জ্য নিয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতার অনেক অভাব। অনেকেই এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানেন না, জানলেও মানতে চান না। এখানে মানুষ কিছুদিন পরপরই টেলিভিশন, স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বদলায়। পুরোনো বেশির ভাগ সরঞ্জাম পুনঃব্যবহার হয় না। সেগুলোর স্থান হয় অন্যান্য গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে আস্তাকুঁড় বা ডাস্টবিনে। আমাদের অসচেতনতার কারণে দিনকে দিন বাংলাদেশ ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।
ই-বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি বিধিমালা করেছে। গত ১০ জুন বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের বিধিমালাটির গেজেট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, এখন থেকে বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিক পণ্য থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানকেই ফেরত নিতে হবে। নষ্ট হওয়া মুঠোফোন, ল্যাপটপ থেকে যেকোনো বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্য প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিলে ভোক্তারা বিনিময়ে টাকা পাবেন। এ ক্ষেত্রে একটি লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উৎপাদিত ই-বর্জ্যের ৫০ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে। এই বিধিমালায় গৃহস্থালি ও মেডিকেল সরঞ্জামের পাঁচ শ্রেণির ৭১টি বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্যে বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহারের মানমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। ই-বর্জ্য পরিবহন সম্পর্কে ধারা ১৮-তে বলা আছে, ‘ই-বর্জ্য পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পরিবহন করতে হবে।’ মজুদ করার স্থানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। মজুদকালীন বা তার আগে-পরে ই-বর্জ্য যেন কোনোভাবেই মাটি পানি ও বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায় এজন্য সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শুধুমাত্র সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে ই-বর্জ্য থেকে পরিবেশ ও নিজেদের রক্ষা করতে আমাদের অনেক কিছুই করার আছে। যেমন ধরুন, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ একটি লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। লোহা, তামা, সোনা, রূপা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়াম সহ এইসব ই-বর্জ্যে অনেক অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু ও অন্যান্য উপাদান আছে, যেগুলি পুনঃ চক্রায়ন করা সম্ভব। ইতিমধ্যেই দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ই-বর্জ্য থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে তা পুনঃব্যবহারযোগ্য করে। বাসাবাড়ি থেকে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। বিপণিবিতানগুলোতে পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক নিয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রচারাভিযানও চালাতে পারে। ই-বর্জ্যরে দূষণ দ্বারা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতির আগেই এগিয়ে আসতে হবে আমাকে, আপনাকে আমাদের সকলকে।
লেখক : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক।
বহমৎনরলড়ুপযধশৎধনড়ৎঃু@মসধরষ.পড়স