নির্যাতনের বিচিত্ররূপ

শঙ্কর প্রসাদ দে »

মাঝে মাঝে আবেগতাড়িত হয়ে ভাবি এ বঙ্গে না জন্মিলে কি জীবনভর এতো নির্যাতন দেখতে হতো? কাকিমাকে বিনাদোষে মেজ কাকা বিদেয় করেছিলেন। বেচারি কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। বাবার পিতৃব্য ধনপতি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। বিধবা টুনীদি মরলে সুরবালার ছেলেরা ভাগ্নে হিসেবে এমনিতে সম্পত্তি পেতো। অথচ বুড়ি যাতে জীবদ্দশায় প্রয়োজনে এক ইঞ্চিও জমি বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য ঠুকে দিলো মামলা। টুনীদি প্রায় শতবর্ষ বেঁচেছিলেন এক প্রকার না খেয়ে, ভাইয়ের সংসারে। ঐ দুর্দশা দেখে ভেবেছি সতীদাহের চেয়ে এই কষ্টতো নিতান্ত কম নয়। নমিতা মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে হয়েছে নমিতা খানম। ওর বাবা মাকে একঘরে করা হলো। মাথা মুড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা হলো। বুঝলাম, রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের এতো চেষ্টার পরও বঙ্গের হিন্দুরা পিছিয়ে আছে শতবর্ষ।
বেশ কিছুদিন ধরে অনেকগুলো মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখে বিচলিত। ব্যথিত, বেদনায় কাতর। পতিতা পল্লীর এ সমস্ত মেয়েগুলোর জীবনকাহিনী প্রায় একই। পুরুষকে ভালবেসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রেমিকের হাত ধরে। প্রেমিক বিয়ে নামক একটি প্রহসন করে নিয়ে যায় সুদূর, টানবাজার, দৌলতদিয়া বা কলকাতার সোনাগাছি। প্রেমিক পুরুষ খুব বেশি না, মাত্র বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে আসে সর্দারনির চোখে চোখ রেখে। এইসব হারামজাদাদের বিরুদ্ধে খুব বেশি মামলা হয় না। যাওবা দু’একটি হয়, সাক্ষ্য সাবুদের অভাবে মেয়েগুলো বিচার পায় না। এ কেমন পুরুষ জাত, এ কেমন প্রেমের অভিনয়। একটা মেয়েকে হত্যা করার চেয়ে কঠিন অপরাধ, নিষ্পাপ কিশোরীকে প্রতারণাপূর্বক পতিতা পল্লীতে বিক্রি করা। এ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদ-ের চেয়েও বেশি আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করা উচিত। পুরুষ যুগে যুগে নারীকে প্রতারণা করেছে, শোষণ করেছে, বঞ্চিত করেছে, এখনো করছে। শুধু বদলেছে নির্যাতনের ধরণ। সর্দারনিগুলোর নাম মাসি। বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মাসিরা মায়ের চেয়েও বেশি ¯েœহ করে। অথচ কোন কারণে পতিতা পল্লীর নরপিশাচগুলো মাসি উপাধি পেয়েছে জানি না। হয়তো কথায় কথায় চলে আসছে যুগের পর যুগ। এদের নিষ্ঠুরতাও চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। এরা গতর খাটে না। ভরা যৌবনের মেয়েগুলো খদ্দেরদের কাছ থেকে যা পায় তার থেকে ভাগ নেয় ঘরভাড়া, নিরাপত্তা ও অন্যবিধ কারণে।
এরা দেশের চাঁদাবাজদের শিরোমণি। অস্ত্রধারী চাঁদাবাজদের চেয়ে এরা ভয়ংকর। এদের বিরুদ্ধে কখনো মামলা হয়েছে প্রমাণ নেই। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। রাঙ্গুনিয়ার এক মেয়ে বাড়ি থেকে রাগ করে শহরে চলে আসে। বহদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ডে ওঁতপেতে থাকা এক দালাল আশ্রয় দেবে বলে নিয়ে যায় চান্দগাঁ আবাসিকের এক অভিজাত ফ্ল্যাটে। আসলে ঐ ফ্ল্যাটটি হল অভিজাত পতিতালয়। ঐ ফ্ল্যাটের সর্দারনি মেয়েটিকে কিনে নেয়। তার পরের কাহিনী না বলাই শ্রেয়। প্রায় ৪ মাস পর পালিয়ে থানায় যায় এক খদ্দেরের পরামর্শে। ততোদিনে মেয়েটি গর্ভবতী। ভেবে দেখুন, মেয়েটি যখন রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয় তখন দেখেছে কত মানুষ অথবা নরনারী। পোশাকের আড়ালে এই মানুষগুলো এতো হিং¯্র সে কল্পনাও করতে পারেনি। মেয়েটির মায়ের কাছ থেকে আদ্যোপান্ত শুনে বললাম, অশিক্ষাই মেয়েটির কাল হয়েছে। এ দেশে কোন মেয়েকেই এসএসসির আগে হাতছাড়া করা যাবে না। রাষ্ট্রই সব মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার ভার না নিলে এই সর্বনাশা বিপর্যয় থেকে মেয়েগুলোকে রক্ষা করা দুরূহ।
মামলা করতে গিয়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার দেখা পেলাম। মেয়েরা যৌতুকের জন্য মামলা করে। যৌতুকের জন্য স্বামী মারপিট করেছে বলে মামলা করে। বলছি না স্বামীর হাতে বউ মরে না বা নির্যাতিত হয় না। অনেক অভিমানী আবার আত্মহত্যা করে জীবনপাট চিরতরে চুকিয়ে ফেলে। মজার কথা হলো, এসব হতভাগিনীকে স্বামী হয়তো অল্পস্বল্প নির্যাতন করেছে, মূল নির্যাতনকারী কিন্তু শাশুড়ি অথবা ননদ। এ এক বিচিত্র জীবনবোধ। শাশুড়ি হয়েই সে ভুলে গেল, সেও একদিন বউ হয়ে স্বামীর ঘরে এসেছিল। এ মেয়েকে তাঁর সংসারে নতুন অতিথি অথবা আগন্তুক। মুহূর্তের জন্যও তা মনে করে না। যার সাথে পূর্বে কখনো দেখা হয়নি, সাক্ষাৎ আলাপ হয়নি, তাকে প্রথম দিন থেকেই চরম শত্রু মনে করার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আজো আমি খুঁজে পেলাম না। কার্ল মাকর্সের মতে ধর্মগুলো মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ফসল। আজ পর্যন্ত কোন নারী ধর্ম প্রচারকের দেখা মেলেনি। প্রত্যেকটি ধর্মই যে কোন মাত্রায় নারী বিদ্বেষী। নারীকে গৃহবন্দি, নজরবন্দি, ভোগবন্দি, করার কত সব নিয়মকানুনের ছড়াছড়ি। আমার ফ্ল্যাটটিতে টাইলসের কাজগুলো করেছে মেয়েরা। সেদিন রহমতগঞ্জের নালা পরিষ্কার করছিল মেয়েরা। আমাদের বিল্ডিংয়ের ইট ভাঙে মেয়েরা, কয়েকজনতো কোলের বাচ্চা সাথে নিয়ে আসে। বাচ্চা পাশে ধুলাবালিতে খেলা করে আনমনে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছেলের বাবা কৈ। মেয়েটির উত্তর, ছেলের বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুনছি আরেকটা বিয়া করেছে। বলুনতো দেখি, এদের জীবনে বোরকার মূল্য কি? নামাজ বা প্রার্থনার মূল্য কি? ইহকাল পরকালের মূল্য কি? এদের বেতন পাঁচশ টাকার নিচে। পাঁচশ টাকা ধরলেও এই মহানগরে একটা বা দু’টা বাচ্চা নিয়ে কেমনে ঘরভাড়া হবে। চাল, ডাল নুনইবা কোত্থেকে আসবে। রোগশোকের কথা বাদই দিলাম। এই হতদরিদ্র মেয়েগুলো গ্রাম ছেড়ে শহরে ভিড় করেছে কাজের আশায়। গ্রামেও এখন নগর সভ্যতার ঢেউ লেগেছে। উপজেলা সদরগুলো এক একটি মফস্বল শহর। এখানে মেয়েদের ঝাক। এরা ভিক্ষের জন্য নয় ভিড় জমায় কাজের আশায়। এরা প্রত্যেকে কাজ করে পুরুষ ঠিকাদারের অধীনে। ঠিকাদার প্রত্যেকটি মেয়ের পেছনে কম করে ৯০০ টাকা নেয়। এদের দেয় ৪৫০ টাকা। এ যে নব্য দাস প্রথা। পুঁজিবাদী দাসপ্রথা। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে এসে দাসপ্রথার স্বরূপ বদলেছে। উচ্ছেদ হয়নি। নিষ্ঠুরতার স্বরূপ বদলেছে। মাত্রা কমেনি।
মনে পড়ে গেল করোনাকালীন ঈদ পরবর্তী রুবানা হকের কীর্তিকলাপ। তিনি প্রচ- লকডাউনের মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিকগুলোকে বিশ ত্রিশ পঞ্চাশ মাইলের বেশি হাঁটিয়ে ঢাকা আসতে বাধ্য করেছিলেন। না হলে যে চাকরি চলে যাবে। এ সমাজে মানুষের চেয়ে চাকরির মূল্য বেশি। ফেরি পার হওয়ার সময় মানুষে ঠাসা দৃশ্য দেশবাসীর হৃদয় নাড়া দিয়েছে। ট্রাকভর্তি কোরবানির গরুর বোঝাই আর মানুষ বোঝাই ফেরিগুলোর অবস্থা একই। আসলে পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমরা ড্রাইভারদের পনের হাজার টাকা বেতন দেই। আমরা কেউ কি ভেবে দেখেছি, ভাবলেও কি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি মাত্র পনের হাজার টাকায় কিভাবে তিন চারজনের একটি সংসার চলে? আসলে যতই সময় গড়াচ্ছে, ততই যেন আমরা বর্বর হয়ে উঠেছি। কোন ডাক্তার তো ড্রাইভার পরিচয় দেবার পর এক হাজারের পরিবর্তে দু’শো টাকা ফিস নেন না। অন্য দেশের কথা জানি না। ব্যতিক্রম বাদে এদেশে যে যত শিক্ষিত সে তত দুর্নীতিবাজ, ঠকবাজ, হারামখোর আর গরিব ঠকানোতে ওস্তাদ। তীব্র রোদ বা ঝড় বৃষ্টিতে রিকশা সিএনজি ওয়ালা বিশ ত্রিশ টাকা ভাড়া বেশি চাইলে মারতে উঠি। ৫ সেপ্টেম্বর আমার ভ্রাতুষ্পুত্রকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ম্যাক্স হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বিধান বাবুকে কল দিতে বললাম। তিনি বললেন, কভিড সময়ে তিনি সাধারণত বের হন না। তিন হাজার টাকা ফি দিলে তবেই আসবেন। এলেন। রোগী দেখলেন, তিন হাজার টাকা গুনে নিয়ে সার্জারির ডাক্তার রেফার করে চলে গেলেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর ডায়াগনসিস সঠিক ছিল। কিন্তু ঠেকায় ডাক্তার হয়ে সুনাম কি তাঁর বাড়লো না ডাক্তার সমাজের বাড়লো। আসলে দোষ ডা. বিধানের নয়। তিনিসহ শিক্ষিত মানুষ মাত্রই আমরা যে যেখানে আছি এ দেশের গরিবের জন্য ফাঁদ পেতেছি মাত্র। বলা হয় জিডিপি এতো বাড়ার পরও গ্রামের গরিব মানুষের এই বেহাল দশা কেন। তিন পুরুষ ধরে যারা গরিব, চতুর্থ পুরুষেরাও তাদের বেশির ভাগ গরিবই থাকলো। উন্নয়নের এই পরিহাস আমার মাথায় ঢুকে না।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট
ঝঢ়ফবু২০১১মসধরষ.পড়স