নির্বাসনের দ্রোহ ও ব্যঞ্জনা : কবি দাউদ হায়দার

মুন্সী আবু বকর »

কবি দাউদ হায়দার, পাবনার দোহারপাড়া থেকে উঠে আসা এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, বাংলা কবিতার আধুনিক প্রেক্ষাপটে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। সময়ের অস্থিরতাকে ধারণ করে তাঁর কবিতা যেমন সমাজের অসঙ্গতি ও রাজনৈতিক ভণ্ডামিকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছে, তেমনই মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও তাতে অনুরণিত হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, একটি কবিতার জন্য তাঁকে দীর্ঘকাল নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়েছে এক বেদনাময় অধ্যায় যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে রেখেছে।
সত্তরের দশকে যখন বাংলা কবিতা নতুন পথের সন্ধানে, তখন দাউদ হায়দারের কবিতা এক ব্যতিক্রমী সুর নিয়ে হাজির হয়। তাঁর কাব্যে দ্রোহের আগুন ছিল প্রখর, যা তথাকথিত সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাত। ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” এই একটি কবিতা যেন তাঁর জীবনের গতিপথ পাল্টে দিল। জনমনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ১৯৭৪ সালে তাঁকে কারাবরণ করতে হয় এবং পরবর্তীতে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়। এই নির্বাসন কেবল ভৌগোলিক দূরত্ব তৈরি করেনি, বরং তাঁর কবিসত্তাকে আরও ঋদ্ধ ও প্রতিবাদী করে তুলেছিল।
দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে দাউদ হায়দার প্রথমে ভারতে প্রায় ১৩ বছর কাটান, এরপর ১৯৮৭ সাল থেকে জার্মানির বার্লিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। দূর প্রবাসেও তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও, তাঁর কলম সর্বদা সচল ছিল। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ”-এর মতো কাব্যগ্রন্থ আজও তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন সমাজের অন্ধকার দিকগুলির নির্মোহ চিত্রায়ণ দেখা যায়, তেমনই অন্যদিকে নিপীড়িত মানুষের জন্য গভীর সহানুভূতিও প্রকাশিত হয়। ‘বেলাভূমে যখন হাঁটছিলাম’ কাব্যগ্রন্থে যেন একাকী নির্বাসিত জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, যেখানে স্মৃতির ধূসর আকাশ আর বর্তমানের নিঃসঙ্গতা একাকার হয়ে যায়।
দাউদ হায়দারের কাব্যে তীক্ষè ব্যঙ্গ ও শ্লেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিনি সমাজের ভণ্ডামি, রাজনৈতিক কপটতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিকে কশাঘাত করতে দ্বিধা করেননি। তাঁর কবিতার ভাষা যেমন বলিষ্ঠ, তেমনই চিত্রকল্পগুলি আধুনিক ও ব্যঞ্জনাময়। ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’ অথবা ‘লক্ষ্মীছাড়ার ইহলোক’-এর মতো কাব্যগ্রন্থগুলিতে তিনি যেন এক নির্মোহ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে সমাজের গলদগুলি তুলে ধরেছেন। তাঁর নাস্তিক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁর লেখায় স্পষ্ট প্রভাব ফেলেছে, যা অনেক সময় বিতর্ক সৃষ্টি করলেও মুক্তচিন্তার পরিসরকে প্রসারিত করতে সহায়ক হয়েছে।
পারিবারিক প্রেক্ষাপটেও দাউদ হায়দার ছিলেন ব্যতিক্রমী। তাঁর আরও তিন ভাই জিয়া হায়দার, রশিদ হায়দার ও মাকিদ হায়দার– সাহিত্য ও শিল্পের জগতে স্বনামধন্য ছিলেন। জিয়া হায়দার ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও অধ্যাপক, যিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। রাশিদ হায়দার সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য এবং অনুবাদসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন। মাকিদ হায়দার ছিলেন কবি ও লেখক এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত। একই পরিবারে চার ভাইয়ের সাহিত্যচর্চা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নির্বাসিত জীবনে দাউদ হায়দার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে লন্ডনভিত্তিক পোয়েট্রি সোসাইটি তাঁর একটি কবিতাকে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা এশিয়া” পুরস্কারে সম্মানিত করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিহীনতার বেদনা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, তবুও তিনি জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি, কারণ তাঁর হৃদয়ে সর্বদা বাঙালি পরিচয় অমলিন ছিল। জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট ব্যবহার করে তিনি বিশ্বভ্রমণ করেছেন। সবসময় শেকড়ের টান অনুভব করতেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বার্লিনে নিজের বাসায় সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন এবং দীর্ঘদিন আইসিইউতে ছিলেন। পরবর্তীতে কলোন ক্যান্সার ধরা পড়লে তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। অবশেষে ২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল বার্লিনে তাঁর জীবনাবসান হয়। একটি কবিতার জন্য যে নির্বাসন শুরু হয়েছিল, তা তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এক মর্মান্তিক পরিণতি।
তবে দাউদ হায়দারের প্রয়াণ কেবল একজন কবির তিরোধান নয়, বরং একটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নীরবতা। তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় না থাকলেও, তাঁর কবিতা ও লেখালেখি সর্বদা মুক্তচিন্তার পক্ষে সোচ্চার ছিল। বাংলা ট্রিবিউনে নিয়মিত কলাম লিখে তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতেন, যা আজও পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
দাউদ হায়দার হয়তো আজ আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তাঁর কবিতা এবং নির্ভীক চেতনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। নির্বাসনের দীর্ঘ আর্তি এবং মানবতার প্রতি গভীর মমত্ববোধ তাঁর কবিতাকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, সত্যের পথে অবিচল থাকলে প্রতিকূলতা যতই কঠিন হোক না কেন, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর একদিন না একদিন মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হবেই। কবি দাউদ হায়দারের উত্তরাধিকার আগামী প্রজন্মকে মুক্তচিন্তা ও নির্ভীকতার পথে সর্বদা অনুপ্রাণিত করবে এই আমাদের বিশ্বাস।